দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থা (টেশিস) নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ”সরকারি কম মূল্যের ল্যাপটপ ‘দোয়েল’ বাজারে আসার জন্য এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। বাকি কেবল উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা। আগামী মাসের মধ্যভাগের আগেই (সম্ভাব্য তারিখ ৯ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করবেন।”
তৈরির কারিগররা
১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত টেশিসে একসময় শুধু টেলিফোন সেট উৎপাদিত হতো। তবে এ কাজের ক্ষেত্র কমে আসায় টেশিসের মাধ্যমে নতুন সব উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। তারই একটি ল্যাপটপ তৈরি প্রকল্প। টেশিস সূত্র জানায়, এই ল্যাপটপ তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে ১৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। টেশিসের গাজীপুর কারখানায় গত ১০ জুলাই দোয়েলের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। ল্যাপটপটির উন্নয়ন এবং গবেষণার কাজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট এবং মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘থিম ফিল্ম ট্রান্সমিশন’ বা টিএফটিসহ কয়েকজন বিদেশি বিশেষজ্ঞের সহায়তা থাকলেও এর নকশা, গবেষণা এবং উন্নয়নের কাজ করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ‘গণনা টেকনোলজিস’।
দোয়েল ল্যাপটপের কনটেন্ট প্রস্তুতকরণ, অপারেটিং সিস্টেম অনুবাদকরণ থেকে শুরু করে এর সব পরিকল্পনার কাজও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গণনা টেকনোলজিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল চৌধুরী শারুন জানান, ‘সরকারিভাবে এ ল্যাপটপ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে, যাতে একেবারে গ্রামপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পেঁৗছে দেওয়া যায়। একজন গ্রামের মানুষ যাতে সহজেই এ ল্যাপটপের সবকিছু বুঝতে পারেন সে জন্য আমরা কাজ করছি। এর অপারেটিং সিস্টেমসহ অন্যান্য সুবিধা বা অ্যাপ্লিকেশনগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে কারো কাছে এটি কঠিন না মনে হয়।’
আসছে চারটি ভিন্ন মডেলে
টেশিস সূত্র জানায়, আসলে সব ধরনের গ্রাহকের চাহিদা একরকম নয়, একেকজন ল্যাপটপে একেক ধরনের কাজ করে থাকেন। এ জন্য চাহিদার ওপর ভিত্তি করে আমরা চারটি ভিন্ন মডেলে ‘দোয়েল’ ল্যাপটপ বাজারে আনছি। আর কনফিগারেশনের ওপর ভিত্তি করে মডেলগুলোর দামেও বেশ পার্থক্য রয়েছে। মডেলগুলো হলো
‘দোয়েল প্রাথমিক ২১০২’, ‘দোয়েল বেসিক ০৭০৩’, ‘দোয়েল স্ট্যান্ডার্ড ২৬০৩’ এবং ‘দোয়েল অ্যাডভান্স ১৬১২’।
‘দোয়েল প্রাথমিক ২১০২’
মডেলটিতে রয়েছে ১০ ইঞ্চি এলসিডি প্যানেল, ৫১২ মেগাবাইট র্যাম, ০.৩ মেগাপিক্সেল ইন্টিগ্রেটেড ওয়েবক্যাম, ওয়াইফাই সংযোগ সুবিধা, ইথারনেট লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কিং সুবিধা, ২ ইউএসবি ২.০ পোর্ট এবং ৩২ গিগাবাইট পর্যন্ত ধারণক্ষমতার এসডি স্লট। এর অপারেটিং সিস্টেস হিসেবে রয়েছে গুগলের ‘অ্যানড্রয়েড’।
‘দোয়েল স্ট্যান্ডার্ড ২৬০৩’
মডেলে ১২.১ ইঞ্চি ডাবি্লউএক্সএ এলইডি ব্যাকলাইট, ইনটেল অ্যাটম প্রসেসর, ইনটেল এনএম ১০ এক্সপ্রেস চিপসেট, ইন্টেল জিএমএ ৩১৫০ ইন্ট্রিগ্রেটেড গ্রাফিক্স, ২ গিগাবাইটের ডিডিআর থ্রি র্যাম, ২৫০ গিগাবাইট সাটা হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, ১.৩ মেগাপিক্সেলের ওয়েবক্যাম, ওয়াইফাই, লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কিং সমর্থন এবং তিনটি ইউএসবি ২.০ পোর্ট। এরও অপারেটিং সিস্টেম ‘লিনাক্স’।
‘দোয়েল অ্যাডভান্স ১৬১২’
মডেলটি উচ্চ-কনফিগারেশনে তৈরি করা হয়েছে। এতে রয়েছে ১৪ ইঞ্চি ডাবি্লউএক্সএ এলইডি ব্যাকলাইট, ইন্টেল পেন্টিয়াম প্রসেসর, ইন্টেল এইচএম ৫৫ চিপসেট, ২ গিগাবাইটের ডিডিআরথ্রি র্যাম, ৩২০ গিগাবাইট সাটা হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, স্যামসাং ডিভিডি রাইটার, ১.৩ মেগাপিক্সেলের ইন্ট্রিগ্রেটেড ওয়েবক্যাম, লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কিং সুবিধা এবং তিনটি ইউএসবি ২.০ পোর্ট। এর অপারেটিং সিস্টেমও লিনাক্স।
দরদাম
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, কনফিগারেশনের ওপর ভিত্তি করে ল্যাপটপের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। দোয়েল প্রাথমিক মডেলের সম্ভাব্য দাম ১০ হাজার, ‘দোয়েল বেসিক’ ১২ হাজার, ‘দোয়েল স্ট্যান্ডার্ড’ ২১ হাজার এবং ‘দোয়েল অ্যাডভান্স’ মডেলটি ২৫ হাজার টাকায় বাজারে পাওয়া যাবে। তবে টেশিসের পক্ষ থেকে জানা গেছে, এই দাম এখনো নিশ্চিত নয়। তবে উলি্লখিত দামের খুব বেশি হেরফের হওয়ার আশঙ্কা কম। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের সময়ই চূড়ান্ত দাম ঘোষণা করবেন।
যা থাকছে দোয়েলে
প্রতিটি দোয়েল ল্যাপটপের সঙ্গে বিশেষ অনূদিত অপারেটিং সিস্টেমসহ ব্যবহারকারীর প্রয়োজনীয় সাধারণ সব সফটওয়্যারই স্থায়ীভাবে (বিল্ট-ইন) দেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে লেখালেখির সফটওয়্যার ওপেন অফিস, ছবি সম্পাদনার সফটওয়্যার গিম্পসহ উবুন্টুর প্রায় সব সফটওয়্যার। সাধারণ ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখে এসব সফটওয়্যার বিশেষভাবে অনুবাদ করা হয়েছে। বাংলা লেখালেখির জন্য এতে যুক্ত করা হয়েছে জাতীয় কিবোর্ড লে-আউট। গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে এতে সরকারি ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস’ এবং জাতীয় ‘ই-তথ্যকোষ’ অ্যাপ্লিকেশন আকারে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দোয়েলের নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ এবং প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সব পাঠ্যবইও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আর ল্যাপটপের সবগুলো ফিচার সহজে বোঝার জন্য এতে ৫২ থেকে ৫৪ পৃষ্ঠার একটি বিশেষ ম্যানুয়াল দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রতি মাসে ১০ হাজার
ল্যাপটপ তৈরিতে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতি মাসে মাত্র ১০ হাজার ল্যাপটপ বিক্রির জন্য বাজারে ছাড়বে টেশিস। প্রথম মাসে বাজারে ছাড়ার জন্য ইতিমধ্যে ১২-১৩ হাজার ল্যাপটপ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ল্যাপটপ প্লান্ট প্রকল্পের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) নাজিব হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে উৎপাদন আরো বাড়াব, তবে এ জন্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত দরকার। আপাতত প্রতি মাসে ১০ হাজারের বেশি ল্যাপটপ বাজারে আনা সম্ভব হবে না। বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার ল্যাপটপের চাহিদা রয়েছে, এ চাহিদা পূরণের জন্যও আমাদের ব্যাপক উৎপাদনে যেতে হবে। তবে উৎপাদন বাড়ানো এবং এগুলো বাজারে ছাড়ার বিষয়গুলো নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর।’ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়নি বলে জানান তিনি।
প্রশ্নবিদ্ধ অপারেটিং সিস্টেম
দোয়েলের চারটি মডেলেই বিনা মূল্যের এবং ওপেনসোর্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত দাম কম রাখার জন্যই ওপেনসোর্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে টেশিস চাইলে কম মূল্যেই উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে পারত বলে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জব্বার এ প্রসঙ্গে বলেন, ”সরকারি এ কম মূল্যের ল্যাপটপ আনা হয়েছে যে শ্রেণীর মানুষের জন্য তারা ওপেনসোর্স লিনাক্স বা অ্যানড্রয়েড বুঝবেন কি না তা একবারও ভেবে দেখা হয়নি। সাধারণ মানুষ উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমেই অভ্যস্ত। ওপেনসোর্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে তারা বাস্তবতাবর্জিত একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন। সরকার চাইলে তো মাইক্রোসফটের কাছ থেকে অনেক কম মূল্যেই ‘বাল্ক’ হিসেবে অপারেটিং সিস্টেম কিনতে পারত। আর এ অল্প টাকা ল্যাপটপের দামের সঙ্গে যুক্ত হলে ক্রেতাদের খুব বেশি সমস্যা হতো না। কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত এ অপারেটিং সিস্টেমটি দেখে কম্পিউটারকে ‘কঠিন’ বলে মনে করবেন সাধারণ ব্যবহারকারীরা। তাদের মধ্যে কম্পিউটার-ভীতি তৈরি হবে বলে মনে হচ্ছে।”
তবে দোয়েলের প্রোগ্রাম পরিকল্পক এবং ডিজাইনার নাজমুল চৌধুরী শারুন বলেন, ‘আমরা লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করলেও এটি এমনভাবে কাস্টোমাইজ এবং বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে, যাতে একজন সাধারণ মানুষও নূন্যতম কম্পিউটার জ্ঞান দিয়েই এটি ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহারকারীরা এটি উইন্ডোজের চেয়ে আরো সহজে বুঝতে পারবেন_অন্তত এ নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, ‘অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে উইন্ডোজ ব্যবহার করলে ল্যাপটপের দাম প্রায় চার হাজার টাকা করে বেড়ে যেত। ফলে ক্রেতারা বেশ সমস্যায় পড়তেন। আর মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে যে সমস্যা নেই তার প্রমান অ্যান্ড্রয়েডযুক্ত স্মার্টফোনগুলো। বাংলাদেশের সাধারণ ব্যবহারকারীরা এ স্মার্টফোনগুলো সহজভাবেই নিয়েছেন। এগুলো ব্যবহারে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাই মুক্ত অপারেটিং সিস্টেমযুক্ত ল্যাপটপ ব্যবহারে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
আসছে আগামী মাসেই
ইতিমধ্যে এ ল্যাপটপ বাজারে ছাড়ার সব প্রস্তুতিই সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন কেবল প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির জন্যই অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। তিনি জানান, আড়াই বছর ধরে এ ল্যাপটপ বাজারজাত করার জন্য কাজ চলছে। দোয়েল ল্যাপটপ এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য আবেদন পাঠানো হয়েছে। তিনি অনুমোদন দিলেই দ্রুত বাজারজাত করা হবে এই ল্যাপটপ।
টেশিস-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দিনক্ষণ নিশ্চিত না হলেও আগামী ৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর ‘দোয়েল’ উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এটি বাজারে আসবে।
কম মূল্যের এ ল্যাপটপ বাজারে এলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে স্বর্ণযুগের সূচনা হবে মনে করছেন তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্টরা। নতুন এ ল্যাপটপটি হাতে ছুঁয়ে দেখার আশায় আছেন সরকারি-বেসরকারি সব মহলের মানুষই।
No comments:
Post a Comment