আমাদের অন্যান্য নেশার মত সফট এবং এনার্জি ড্রিঙ্কস না পান করলে যেন নেশাই কাটে না !! আমরা অনেকেই এসব পান করতে পছন্দ করি না তার পরেও অবচেতন মনে সফট এবং এনার্জি ড্রিঙ্কস পান করি। এসব ড্রিঙ্কস আমাদের নানা ভাবে ক্ষতি করে। আমরা যদি সচেতন হয়ে চলি এবং অন্যদেরকে সচেতন করি তাহলে দেখা যাবে স্বাস্থ্যগত ভাবে আমরা অনেক সুখি থাকবো। স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল তাহলে এভাবে আর কত দিন আপনার সুখের পাখিকে তিলতিল করে হত্যা করবেন? আসুন আজ আমরা জেনে নিই সফট এবং এনার্জি ড্রিঙ্কস আমরা কেন পান করবো না ?
কারণ আপনি মোটা হতে চান না
মোটা হওয়া মানে শুধু দেখতে খারাপ বা শারীরিক অস্বস্তির ব্যাপারই নয়। ওজন বাড়লে আপনি খুব অনায়াসে যে অসুখগুলোতে আক্রান্ত হবেন তা হলো টাইপ টু ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার,স্ট্রোক, হার্ট এটাক, ক্যান্সার, গলব্লাডারে পাথর, আর্থ্রাইটিস। পরিণামে অকাল মৃত্যু। মোটা হওয়ার সঙ্গে সফট ড্রিংকস-এর একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে। বোস্টনের শিশু হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ এবং হার্ভার্ড স্কুল একসাথে গবেষণা করে যা বের করেছে তাহলো, একটি শিশু যদি প্রতিদিন একটা করে বাড়তি সফট ড্রিংকস খায় তাহলে তার ওজন বাড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় ৬০%। এক বোতল বা এক ক্যান সফট ড্রিংকসে ক্যালরির পরিমাণ হলো ১৬০ যা ১০ চামচ চিনির সমান। এ পরিমাণ ক্যালরি ঝরাতে সপ্তাহে আপনাকে ভারী ব্যায়াম করতে হবে সাড়ে ৪ ঘণ্টারও বেশি। কিন্তু আপনি কি তা করেন? তাহলেই বুঝুন পরিণতি!
কারণ আপনি আপনার দাঁত হলুদ বানাতে চান না
ধরুন, আপনি আপনার বন্ধুদের একটা জাদু দেখাতে চান। আপনার ধবধবে সাদা মুক্তোর মতো দাঁতগুলোকে আপনি ১ ঘণ্টার মধ্যে স্থায়ীভাবে হলুদ করে ফেলবেন। কিছুই না, এক ঢোক কোলা মুখে নিয়ে ১ ঘণ্টা ধরে রেখে দিন। ব্যস, এনামেল ক্ষয়ে দাঁতগুলো হলুদ হয়ে যাবে। সফট ড্রিংকসের ঝাঁঝালো স্বাদ বাড়ানোর জন্যে এতে ফসফরিক এসিড ব্যবহার করা হয়। এ এসিড এত শক্তিশালী যে, একটা নখ এর মধ্যে ডুবিয়ে রাখলে ৪ দিন পর আর আপনি নখটাকে খুঁজে পাবেন না। তাছাড়া সফট ড্রিংকসে যে চিনি ব্যবহার করা হয়, ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে এটাও এসিড তৈরি করে।
কারণ আপনি ভঙ্গুর হাড় চান না
ফসফরিক এসিডের আরেকটি কাজ হলো হাড়ের ক্যালসিয়ামকে ক্ষয় করা। ১৯৯৪ সালে টিনএজ মেয়েদের ওপর চালানো হার্ভার্ডের এক গবেষণায় দেখা যায়, যে মেয়েরা সফট ড্রিংকস পান করে অন্যদের তুলনায় তাদের হাড়ভাঙার প্রবণতা ৫ গুণ বেশি। পরবর্তীকালে অস্টিওপরোসিস নামক হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ এদের হতে পারে। এ রোগে হাড়ের ঘনত্ব কমে এবং গঠন দুর্বল হয়ে যায়। ফলে হাড় সহজে ভেঙে যায়। সাধারণত বয়স্ক মহিলাদের এ রোগটি বেশি দেখা দেয় আর আশঙ্কার কথা হলো, ভাঙা হাড় আর সহজে সেরে ওঠে না। ২,৫০০ প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার ওপর এ ধরনের আরেকটি গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, এমনকি যারা নিয়মিত দুধ বা অন্যান্য ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন তারাও কোলাজাতীয় ড্রিংকসের ক্ষতিকর এ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেন নি।
কারণ আপনি আসক্ত হতে চান না
প্রতি বোতল সফট ড্রিংকসে ক্যাফেইন আছে ৫০ মিলিগ্রামের মতো। সফট ড্রিংকস কোম্পানিগুলোর দাবি- এটা তারা ব্যবহার করছে স্বাদ বাড়ানোর জন্যে। কারণ ক্যাফেইনের তেতো স্বাদ অন্যান্য ফ্লেভারকে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু জন হপকিন্স মেডিকেল ইনস্টিটিউটের রোলান্ড গ্রিফিথ বেশ কয়েকজন মানুষকে বাজারের সাধারণ সফট ড্রিংকস এবং ক্যাফেইন ছাড়া ড্রিংকস খেতে দিয়ে দেখেন, ৯২% জনই এ দুটোর পার্থক্য বুঝতে পারে নি। তার মানে ক্যাফেইনের স্বাদের ব্যাপারটি সঠিক নয়। তাহলে ক্যাফেইন দিয়ে কী হয়? ক্যাফেইন আসলে আসক্তি সৃষ্টি করে। আপনি একবার যখন এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন আপনি তখন শুধু এটাই চাইবেন। আর সব আসক্তি সৃষ্টিকারী উপাদানের মতো ক্যাফেইনও সাময়িকভাবে আপনার মুডকে চাঙ্গা করলেও দীর্ঘমেয়াদে এর রয়েছে অনেকগুলো ক্ষতিকর দিক। যেমন, এক বা দুই বোতল সফট ড্রিংকসই আপনার অনিদ্রা, নার্ভাসনেস ও দ্রুত হৃৎস্পন্দন সৃষ্টির জন্যে যথেষ্ট। বেশি পরিমাণে খেলে তা অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন থেকে শুরু করে আতঙ্ক এবং উদ্বেগ প্রবণতা, পেশিতে টান লাগা, অসংলগ্ন কথাবার্তা, বিষণ্নতা এবং উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী মহিলা- যারা সফট ড্রিংকস খেয়েছেন তাদের গর্ভপাত, সময়ের আগেই প্রসব বা কম ওজনের বাচ্চা জন্ম দেয়ার ঝুঁকি বেশি। ক্যাফেইনের আরেকটি প্রভাব হলো, এটা প্রস্রাবের প্রবণতা বাড়ায় এবং দেহকে পানিশূন্য করে ফেলে। তার মানে প্রখর রোদের মধ্যে সফট ড্রিংকস খেয়ে আপনি হয়তো ভাবছেন- যাক, শরীর থেকে যে ঘাম ঝরে যাচ্ছে তা পূরণ করছেন। আসলে ফল তার উল্টো। তার চেয়ে বরং পানি খান।
কারণ আপনি বদহজমে ভুগতে চান না
আমরা অনেকেই রিচফুড খাওয়ার পর সফট ড্রিংকস খেতে চাই এ ধারণায় যে, এতে খাবার দ্রুত হজম হবে। অথচ এটা যে কত ভুল ধারণা তা একটু বললেই পরিষ্কার হবে। আমাদের দেহ সাধারণত ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খাবার হজম করে থাকে। কিন্তু সফট ড্রিংকস যখন পরিবেশন করা হয়, তখন এর তাপমাত্রা থাকে ৩/৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কাজেই খাবার গ্রহণের পর যখন ঠান্ডা কোমল পানীয় পান করা হয়, তখন হজমে তো সাহায্য করেই না, উল্টো তাতে পচন ধরায়। তাছাড়া এসিডিক হওয়ার কারণে সফট ড্রিংকস পাকস্থলীর সংবেদনশীল এলকালাইন ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে। ফলে পেট ব্যথা, ফুলে যাওয়া, বদহজম, গ্যাস, টক ঢেকুর ইত্যাদি নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়।
কারণ আপনি ডায়াবেটিস বাঁধাতে চান না
চিনি এবং ওজনে এর ভূমিকার কারণে সফট ড্রিংকস ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের ৪ বছর ধরে চলা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে মহিলারা সফট ড্রিংকস বেশি খান, তাদের টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সাধারণ মহিলাদের চেয়ে ২ গুণ বেশি।
কারণ আপনি ক্যান্সারের রোগী হতে চান না
সফট ড্রিংকস দেহে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ক্যারামেলের রং আনার জন্যে সফট ড্রিংকসে পলি-ইথিলিন গ্লাইকোল নামে যে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা ক্যান্সার সৃষ্টির জন্যে দায়ী। মজার ব্যাপার হলো, ‘ডায়েট কোলা’ নামে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে যে সফট ড্রিংকস বিক্রি হয় তাতে চিনির পরিবর্তে এসপার্টেম নামে একটি কেমিকেল ব্যবহার করা হয়। দেহের ওপর এ উপাদানটির রয়েছে ৯২ ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব। তার মধ্যে রয়েছে ব্রেন টিউমার, বন্ধ্যাত্ব, ডায়াবেটিস, মৃগী এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতা।
কারণ কিডনি ডায়ালাইসিসকে আপনি খুব সুখকর কিছু মনে করেন না
সফট ড্রিংকস যাতে বরফের মতো জমে না যায় সেজন্যে এতে ইথিলিন গ্লাইকোল নামের একটি উপাদান ব্যবহার করা হয়। এটি প্রায় আর্সেনিকের মতোই একটি বিষ। কিডনির ওপর এর প্রভাব খুব ক্ষতিকর। ১ ঘণ্টায় আপনি যদি ৪ লিটার কোক খান তাহলে কিডনি ফেইলিওর হয়ে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন- যারা সফট ড্রিংকস খান না বা পরিমিত খান, তাদের তুলনায় যারা প্রচুর পরিমাণে খান, তাদের কিডনিতে পাথর জমার হার প্রায় তিনগুণ! সফট ড্রিংকসে যে স্যাকারিন ব্যবহার করা হয়, তাতে ইউরিনারি ব্লাডার ক্যান্সার অর্থাৎ মূত্রাশয়ের ক্যান্সার সৃষ্টি করে।
কারণ আপনি শ্বাসকষ্টে ভুগতে চান না
সফট ড্রিংকসের তাৎক্ষণিক বিপদ হচ্ছে গলা বা শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি। আমাদের নাকে, গলায় তথা শ্বাসতন্ত্রের শুরুর দিকের অংশে থাকে অসংখ্য সিলিয়া। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত যে ধূলিকণা, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস গ্রহণ করি এই সিলিয়াগুলো সেগুলোকে শরীরের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়। সফট ড্রিংক খেলে এসব সিলিয়াগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। শুরু হয় টনসিলাইটিস, ফেরিংজাইটিস, ল্যারিংজাইটিস, ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো শ্বাসজনিত রোগ।
কারণ কীটনাশককে আপনি খাওয়ার জিনিস মনে করেন না
২০০৪ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ও ছত্তিশগড় রাজ্যে কৃষকরা কোকাকোলাকে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে অন্ধ্র প্রদেশের রামকৃষ্ণপুরমের চাষী গটু লখমাইয়া বলেন, আমার তুলা চাষের কয়েক হেক্টর জমি জুড়ে আমি সফট ড্রিংকস স্প্রে করেছি। কারণ আমি দেখেছি এতে পোকা মরে যায়। অন্য চাষীরাও বলেছেন, সফট ড্রিংকস প্রচলিত কীটনাশকের তুলনায় দামে যেমন সস্তা, তেমনি ব্যবহারকারীর ত্বকের জন্যেও নিরাপদ।
কারণ আপনি অকালে বুড়িয়ে যেতে চান না
ম্যাসাচুসেটসের ৫০ বছর বয়স্ক একদল নারী-পুরুষ যারা প্রতিদিন ১ ক্যান বা এর বেশি করে সফট ড্রিংকস পান করেছেন, তাদের ওপর ৪ বছর ধরে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মেটাবলিক সিনড্রোম বেড়ে গেছে ৪৪%। মেটাবলিক সিনড্রোম বাড়লে ডায়াবেটিস, হৃদরোগের ঝুঁকি যেমন বাড়ে তেমনি অকালে বুড়িয়ে যায় দেহ।
আর আপনি মুসলিম হলে এটি আপনার জন্যে হালাল না-ও হতে পারে
গবেষক মার্ক পেন্ডারগ্রাস্ট কোকাকোলার ওপর দীর্ঘ গবেষণা করে লিখেছেন দীর্ঘ নামের একটি বই- ফর গড, কান্ট্রি এন্ড কোকাকোলা : ‘দ্য ডেফিনিটিভ হিস্ট্রি অফ দ্য গ্রেট আমেরিকান সফট ড্রিংক এন্ড দ্য কোম্পানি দ্যাট মেকস্ ইট’। এ বইতে তিনি শতাব্দীব্যাপী গোপন করে রাখা কোকের ফরমুলা প্রকাশ করে দিয়েছেন। এ ফরমুলার একটি উপাদান হলো এলকোহল। সুতরাং আপনি যদি মুসলিম হয়ে থাকেন, তাহলে চিন্তা করে দেখুন আপনি কী খাচ্ছেন আর আপনার সন্তানকেই বা কী খেতে উৎসাহিত করছেন।
No comments:
Post a Comment