না, ফুসফুসের যক্ষ্মার পাশাপাশি, হাড়, কিডনি, মস্তিষক, পাকস্থলী, অন্ত্রসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও যক্ষ্মা হতে পারে। একটা সময় যক্ষ্মা মানেই ছিল মৃত্যু। ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা’ প্রবাদটি তৈরিও হয়েছে সে কারণেই। মূলত রোগটি সম্পর্কে না জানা এবং তার চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলেই এমনটা হতো।
যক্ষ্মা কেন হয়?
যক্ষ্মা একটি প্রাচীন রোগ। চার হাজার বছর আগেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তখন অবশ্য রোগটি সম্পর্কে তেমন জানা ছিল না মানুষের। এমনকি এও জানা ছিল না, এটি কোন ধরনের রোগ।
বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রযাত্রায় জানা যায়, যক্ষ্মা বা টিউবারকিউলোসিস (টিবি) হলো একটি ইনফেকশন বা প্রদাহজনিত রোগ, যা ব্যাকটেরিয়া নামক এক ধরনের জীবাণুর মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। ব্যাকটেরিয়াটির নাম হলো মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস। ১৮৮২ সালে জার্মান চিকিৎসক রবার্ট কচ সর্বপ্রথম যক্ষ্মা রোগের জীবাণু শনাক্ত করতে সক্ষম হন এবং ১৯০৫ সালে এই আবিষকারের জন্য তিনি নোবেল পুরষকার পান।
টিবির কারণে ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটলেও দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও টিবি দেখা দিতে পারে। যেমন-মস্তিষক, হাড়, পাকস্থলী, অন্ত্র ইত্যাদি। ফুসফুস ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় টিবির আক্রমণ ঘটলে সেটাকে এক্সট্রা পালমোনারি টিবি বলা হয়। এ ধরনের টিবি মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম গোত্রেরই, কিন্তু ভিন্ন প্রজাতির। বাংলাদেশে এখন ফুসফুসের টিবি রোগীর পাশাপাশি অন্যান্য টিবিতে আক্রান্ত রোগীও অনেক পাওয়া যাচ্ছে।
কীভাবে ছড়ায়?
যক্ষ্মা জীবাণু সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হয়। যক্ষ্মা আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির থুথু, কফ, হাঁচি, কাশি ইত্যাদি দ্বারা বাহিত জীবাণু অন্য কেউ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে তারও যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার এ রোগের জীবাণুযুক্ত পানি পরিশোধন অর্থাৎ না ফুটিয়ে পান করলেও যক্ষ্মা হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সপর্শ করলে বা তার সঙ্গে করমর্দন করলে যক্ষ্মা হয় না।
কাদের হয়?
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এলাকায় জনবসতি বেশি, কম জায়গায় অনেক মানুষ গাদাগাদি করে বাস করে, বাতাস চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত স্থান নেই, সেসব জায়গায় যক্ষ্মা রোগের প্রকোপ অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি। তা ছাড়া স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। অপুষ্টিজনিত কারণেও দেহে যক্ষ্মার জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে যে দারিদ্র্য ও বসবাসের স্থানের সঙ্গে যক্ষ্মা রোগ সংক্রমণের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের নিম্ন আয়ের লোকজন, গার্মেন্টসকর্মী এবং যারা জীবিকার তাগিদে শহরে এসে বস্তিতে থাকতে বাধ্য হয়েছেন তারা বেশি যক্ষ্মার ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
আরো কয়েকটি কারণ
গাদাগাদি করে এক ঘরে বহু লোকের বসবাস যক্ষ্মার অন্যতম কারণ। স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা পরিবেশ যে যক্ষ্মা জীবাণুর প্রজননে অত্যন্ত অনুকূল তা আগেই বলা হয়েছে; কিন্তু আরো কিছু রোগ আছে, যেগুলো যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। যেমন-যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ভবিষ্যতে যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার এইডস আক্রান্ত রোগীর মধ্যেও এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। সে জন্য এসব রোগে আক্রান্ত রোগীর যক্ষ্মা প্রতিরোধে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণসহ কিছু অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
যক্ষ্মার লক্ষণ
প্রাথমিকভাবে যক্ষ্মা রোগের প্রধান লক্ষণ দীর্ঘদিনেও না সারা কাশি। কফের সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে রক্তও পড়তে দেখা যায়। এ জন্য কাশির স্থায়িত্ব তিন সপ্তাহের বেশি হলেই দ্রুত কফ পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। কারো কারো ক্ষেত্রে আবার জ্বরও অনুভূত হয়। কিন্তু এ জ্বরের তীব্রতা টাইফয়েডের মতো বেশি না। জ্বর সাধারণত বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে আসে এবং রাত বাড়লে ঘাম দিয়ে ছেড়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির খাওয়াতেও রুচি থাকে না। ফলে স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হতে থাকে, অল্প পরিশ্রমেই দেহ ক্লান্ত হয়ে পড়ে ও ওজন কমে যায়।
যদি সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করা হয় তাহলে দেখা দেয় আরো জটিলতা। এর মধ্যে একটি হলো ফুসফুসে পানি (এমফাইসিমা) বা বাতাস (নিউমোথোরাঙ) ঢুকে যাওয়া। কখনো কখনো ফুসফুসে ইনফেকশন দেখা দেয়। তার পরও যদি চিকিৎসা না নেয়া হয় তাহলে হতে পারে মেনিনজাইটিস। এভাবে সারা দেহে যেমন-হাড়, পাকস্থলী, কিডনি, যকৃতে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে এবং রোগী ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
কীভাবে নির্ণয় করা যায়?
সবচেয়ে প্রচলিত পরীক্ষা হলো আক্রান্ত ব্যক্তির কফ পরীক্ষা করা। ফুসফুসের যক্ষ্মা নির্ণয়ের জন্য বুকের এক্স-রে করা হয়। টিউবারকিউলিন স্কিন টেস্ট নামে আরেকটি পরীক্ষাও চিকিৎসকরা করে থাকেন। অণুজীববিজ্ঞানের জনক রবার্ট কচ এই টিউবারকিউলিন পরীক্ষার মাধ্যমেই সর্বপ্রথম যক্ষ্মার জীবাণু আলাদা করেছিলেন। দেহে যক্ষ্মার জীবাণু আছে কি না সেটি নিশ্চিত করতে বর্তমানে একটি বিশেষ ধরনের রক্ত পরীক্ষা করারও পরামর্শ দেয়া হয়। তবে এই পরীক্ষাটি বেশ ব্যয়সাপেক্ষ।
উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো ছাড়াও সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) টিবি পরীক্ষা করার জন্য নতুন এক ধরনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। আশা করা যায় নতুন এই পদ্ধতির মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরো কম সময় ও প্রাথমিক পর্যায়েই সব ধরনের টিবি শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
কোথায় যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা করা হয়?
রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রায় সব বড় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রভৃতি জায়গায় যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা করা যায়। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় বিনা মূল্যে কফ পরীক্ষা করা হয়। পালমোনারি বা ফুসফুসের টিবি নির্ণয় পদ্ধতি সারা দেশেই সম্ভব। পরীক্ষাটি করাও সহজ। তবে অন্যান্য টিবি নির্ণয়ে ভিন্ন ধরনের টেস্টের প্রয়োজন হয়।
যক্ষ্মার চিকিৎসা কী?
যক্ষ্মা রোগ নিরাময় একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ জন্য অন্তত ছয় মাস ধরে পরিমিত ও নিয়মিতভাবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী ওষুধ খাওয়া আরম্ভ করার পর কিছুটা ভালোবোধ করলেই অ্যান্টিবায়োটিক নেয়া বন্ধ করে দেয়-যা কোনোভাবেই উচিত নয়। এতে ব্যাকটেরিয়া ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং ওষুধ কার্যকারিতা হারায়। তখন আরো উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। এভাবে চলতে থাকলে একসময় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই আর যক্ষ্মা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে না। তখন রোগটির চিকিৎসা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যক্ষ্মার প্রতিষেধক
বেসাইল ক্যালমেটে গুয়েরিন বা বিসিজি নামে এক ধরনের টিকা টিবির প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে বিসিজি টিকা সাধারণত শিশুদের দেয়া হয়। অবশ্য একবার এই টিকা দেয়া থাকলেও পরবর্তী সময়ে টিবি আর হবে না, সেটা বলা যায় না। তা ছাড়া টিকা দেয়া দেহ টিউবারকিউলিন স্কিন টেস্টে পজিটিভ ফল দেয় বলে ক্ষেত্রবিশেষে এটি চিকিৎসার সময় কিছু সংশয়ও তৈরি করে। তার পরও প্রাথমিক প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে টিকা গ্রহণ করা উচিত। বিভিন্ন দেশ যক্ষ্মার আরো উন্নততর প্রতিষেধক আবিষকারের জন্য ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
যক্ষ্মা রোগের আরেক নাম ক্ষয়রোগ। অর্থাৎ এ রোগে দেহের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, অল্প বয়সেই বার্ধক্য শরীরকে গ্রাস করে। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ শনাক্ত করা যায় ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে এসব দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব প্রতিরোধ করা তেমন কঠিন নয়। তাই সবারই সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
যক্ষ্মা প্রতিরোধে বাংলাদেশ
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুহার অন্য যেকোনো রোগের চেয়ে বেশি। অথচ গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে কেমোথেরাপির উদ্ভাবন ও আশির দশকে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধের স্বল্পমেয়াদি মাত্রা নির্ধারণের ফলে একসময় ধারণা করা হয়েছিল যে বিশ্বব্যাপী টিবির সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। কিন্তু এই ভিত্তি অনুযায়ী উন্নত বিশ্বে নতুন করে টিবি সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী হলেও নানা কারণে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সে রকম সন্তোষজনকভাবে কমেনি। এ বিষয়ে আইসিডিডিআরবির পাবলিক হেলথ সায়েন্স ডিভিশনের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও এপিডেমিওলোজিস্ট ডা. কে জামান জানান, আইসিডিডিআরবির সর্বশেষ গবেষণায় দেখা যায় যে বর্তমানে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে টিবির জীবাণু সংক্রমণের হার প্রায় ৭৯ দশমিক ৪, যা কিনা আগের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কর্তৃক চালানো গবেষণায় প্রাপ্ত ফলের চেয়ে কম। আরো দেখা যায় যে পুরুষদের (১৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়স্ক) মধ্যে মহিলাদের চেয়ে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। অনুপাতের হিসাবে মহিলা ও পুরুষের মধ্যে এ হার হচ্ছে ০.৩৩ঃ১।
গবেষণায় আরেকটি দিক উল্লেখ করে ডা. কে জামান বলেন, যক্ষ্মার সংক্রমণের কমে আসার ক্ষেত্র গণমাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে চালানো সচেতনতা কার্যক্রম, সরকারিভাবে বিনা মূল্যে যক্ষ্মা নির্ণয়ের পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও একই সঙ্গে যক্ষ্মা নিরাময়কারী ওষুধের সহজলভ্যতা ডিরেক্টলি অবজার্ভডথেরাপি শর্ট কোর্স বা ডিওটিএস নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এবং সচেতনতা কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়, সেসব স্থানে এখনো যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি। যক্ষ্মা প্রতিরোধে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (এনটিপি) সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতাও পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়তা করছে।
কাশির সাথে রক্ত গেলেই যক্ষ্মা নয়
অধ্যাপক ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ
শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে যক্ষ্মা একটি ভীতিকর রোগ। যক্ষ্মা রোগীর চিত্র মনে করলেই মানসপটে ভেসে ওঠে একটি ছবি। আর তা হলো রোগী কাশছে আর কাশছে, পরক্ষণেই শুরু হয়ে যাবে কাশির সাথে গল গল করে রক্ত যাওয়া। এ ধরনের অনেক চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কাশির সাথে গল গল করে রক্ত যাওয়ার। অনেক চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধা অথবা পুরনো দিনের ছায়াছবি মেঘে ঢাকা তারাসহ অনেক গল্পে। ফুসফুসের যক্ষ্মা হলে কাশির সাথে রক্ত যেতেও পারে আবার নাও পারে। তবে কাশির সাথে রক্ত যাওয়াকে আমি রোগীর জন্য আশীর্বাদ মনে করি। কারণ কফ-কাশি আর জ্বরে জ্বরে শীর্ণ হয়ে গেলেও যতক্ষণ পর্যন্ত কাশির সাথে রক্ত না যাচ্ছে ততক্ষণ রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার জন্য গুরুত্ব দেয় না। আবার আমরাও অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের পর অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ এবং পরিবর্তন করতে থাকি।
প্রকৃতপক্ষে নিয়ম হলো, বাংলাদেশে তিন সপ্তাহের বেশি কাশি বা দুই সপ্তাহের জ্বর চলতে থাকলেই যক্ষ্মার কথা সন্দেহ করা উচিত যদি অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ না দেয়। আর এই সন্দেহ খুবই প্রয়োজনীয়, কারণ এই সন্দেহই চিকিৎসককে দেবে রোগ নির্ণয়ের সঠিক ঠিকানা। ফুসফুসে যক্ষ্মা হলে কাশির সাথে রক্ত যায়, এটা যেমন ঠিক তেমনি আবার যক্ষ্মা ছাড়া ফুসফুসে অন্যান্য রোগেও কাশির সাথে রক্ত যেতে পারে। যেমন-ব্রংকাইটিসি, ফুসফুসে ফোড়া, ফুসফুসে ক্যান্সার, নিউমোনিয়া ইত্যাদি।
ফুসফুসে ফোড়া ও কিছু হৃদরোগ আছে; যেমন মাইট্রাল ভাল্ব সরু হয়ে গেলেও কাশির সাথে রক্তপাত হতে পারে। এই কয়টি প্রধান কারণ ছাড়াও আরো অনেক কারণে এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে যেহেতু বাংলাদেশে যক্ষ্মা একটি অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যসমস্যা, তাই যক্ষ্মার ব্যাপারে সন্দেহ অবশ্যই চিকিৎসককে মনে আনতে হবে। ব্রংকাইটিস ফুসফুসের শ্বাসনালির একটি রোগ। ব্রংকাইটিস নামটার সাথে কমবেশি আমরা অনেকেই পরিচিত, যদিও ব্রংকাইটিস নামটা একটু জটিল হওয়ায় এই রোগের নাম অনেকেই শোনেননি। ব্রংকাইটিস হলে ফুসফুসের বিশেষ অংশের শ্বাসনালির অভ্যন্তরীণ কাঠামো নষ্ট হয়ে স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বেশি ফুলেলি সেগুলো আর কার্যক্ষম থাকে না। এই রোগের অনেক কারণ রয়েছে; যেমন ছোটবেলায় হুপিংকাশি, নিউমোনিয়া, হাম বা যক্ষ্মা হলে সেগুলো যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা করা না হয়, তবে তার জটিলতায় এই ব্রংকাইটিস দেখা দিতে পারে। অনেকেই হামকে মামুলি রোগ মনে করে গুরুত্ব দেন না বরং অপচিকিৎসা করে থাকেন। হাম, নিউমোনিয়া, হুপিংকাশি দেখা দিলে তার সুষ্ঠু, সুন্দর চিকিৎসার প্রয়োজন। এই রোগ দেখা দিলে রোগীর কাশির সাথে প্রচুর রক্তপাত হতে পারে এবং তার সাথে জ্বর ও প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত হলুদ পাকা কফ যা কিনা সকালে বেশি দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে লক্ষণগুলো যক্ষ্মার মতোই হয়ে থাকে। ব্রংকোগ্রাম করে এই রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। একজন যক্ষ্মা রোগী পূর্ণ চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও তার কাশির সাথে কিছু রক্ত যেতে পারে। কফে রক্ত যাওয়ার ফলে আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক রোগী অকারণে মাসের পর মাস যক্ষ্মা রোগের ওষুধ খেয়ে চলেছে, যার হয়তো কোনো প্রয়োজন ছিল না।
এ ছাড়া ফুসফুসে ফোড়া দেখা দিলেও রোগীর জ্বর থাকে। পাকা হলুদ কফ যায় এবং কফের সাথে রক্ত দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রেও রোগীকে অনেক সময় যক্ষ্মা রোগের ওষুধ দেয়া হয় যক্ষ্মা ভেবে। যদিও আমার কাছে কোনো জরিপ নেই, তবুও এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক রোগী অনেকটা অকারণে শুধু কাশির সাথে রক্ত যাওয়ার জন্যই যক্ষ্মা রোগের ওষুধ খেয়েছেন বা খাচ্ছেন।
পাশ্চাত্যে, এমনকি আমাদের দেশেও ফুসফুসের ক্যান্সার বয়স্ক পুরুষ তথা মেয়েদের মাঝে ক্যান্সারে আক্রান্ত মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আর ফুসফুসের ক্যান্সারের অন্যতম উপসর্গ হলো কাশির সাথে রক্তপাত। যদিও যক্ষ্মা ও ক্যান্সার রোগী উভয়েরই কাশির সাথে রক্ত যায়, তবুও রক্ত যাওয়ার মধ্যে এই দুই রোগে কিছু পার্থক্য রয়েছে। একজন যক্ষ্মা রোগীর কাশির সাথে হঠাৎ করে প্রচুর রক্ত যায়। অপর দিকে ফুসফুসের ক্যান্সারে কাশির সাথে ছিঁড়ে এবং অল্প অল্প রক্ত যায়। ক্যান্সারে রোগীর প্রচুর পরিমাণে ধূমপানের ইতিহাস থাকে। অর্থাৎ ধূমপানের সাথে ফুসফুসের ক্যান্সারের সম্পর্ক খুবই নিবিড়; তবে যক্ষ্মার জীবাণুু আছে কি না কারণ যদি কফে যক্ষ্মা জীবাণু ধরা পড়ে তাহলে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে এটাই সর্বোত্তম চাক্ষুষ প্রমাণ।
একজন বয়স্ক ব্যক্তি যদি বেশ কিছু দিন ধরে কাশতে থাকে, বুকে তার তীব্র ব্যথা থাকে, স্বর বসে যায় এবং কফের সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রক্ত যায় তবে এক মুহূর্ত দেরি না করে একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ এগুলো হলো ক্যান্সারের উপসর্গ। চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এমনকি ব্রংকোসকোপির মাধ্যমে নির্ণয় করবেন সত্যিই রোগী ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছেন কি না। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও রক্ত যাওয়ার কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
হৃদযন্ত্রের মাইট্রাল ভাল্ব সরু হয়ে গেলে, যাকে আমরা মাইট্রাল ভাল্ব স্টেনোসিস বলি, তখনো কাশির সাথে রক্ত যেতে পারে। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিসসহ অনেক রোগেও কাশির সাথে রক্ত যেতে পারে। তাই কাশির সাথে রক্ত গেলেই তাৎক্ষণিক মনে করে নেয়া ঠিক হবে না যে রোগী যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বরং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই রক্ত যাওয়ার কারণ অর্থাৎ প্রকৃত রোগ শনাক্ত করা, তার উপযুক্ত চিকিৎসা উপযুক্ত চিকিৎসক দ্বারা করাতে হবে। তা হলেই ধরা পড়বে রোগ, আর ভালো হবে রোগী।
No comments:
Post a Comment