আপনাকে যদি ১২২ মিনিটের একটি ফিল্ম বানাতে হয় যার মধ্যে ২৫ বছরের গুরুত্বপূর্ন ঘটনাগুলোকে উপস্থাপন করতে বলা হয়, তখন কি করবেন? “২৫ বছর পর” – টাইটেল দিয়ে পচিশ বছর পরের ঘটনা দেখানো খুব কঠিন কিছু নয়, কিন্তু সেতো ২৫ বছর পরের কিছু ঘটনা। মীরা নায়ারকে নিশ্চয়ই বেশ কিছুটা পরিশ্রম করতে হয়েছিল এই সমস্যা সমাধান করার জন্য। তিনি যে সফল হয়েছিলেন তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ “দি নেমসেক”।
নেমসেক ঝুম্পা লাহিড়ির উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। ঝুম্পা লাহিড়ি প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন তার ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিস’ বইয়ের কারনে। ইমিগ্রান্ট ইন্ডিয়ানদের কাহিনীকে, সমস্যাকে তুলে এনেছিলেন তার ছোট ছোট গল্পগুলোতে। নেমসেক এর কাহিনীতেও তাই। আসলে ব্রিটিশরা চলে যাবার পর থেকে যেসব ভারতীয় প্রবাসে বিশেষত: আমেরিকায় পাড়ি জমায়, তাদের পরবর্তী জেনারেশন এখন ব্যবসা বানিজ্য চালাচ্ছে, তৃতীয় জেনারেশনের অনেকেই তাদের জীবন শুরু করেছে। এই দ্বিতীয় জেনারেশন এর জীবনে যে জটিলতা, তা সহজে উপেক্ষা করার নয়। একই সাথে দুই দেশের সমাজ সংস্কৃতি, নিয়ম কানুন বজায় রেখে – একই সাথে বাবা মাকে সন্তুষ্ট রেখে, এগিয়ে যাওয়া, জীবনের কার্যাবলী পালন করতে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠা – সে তো মোটেই অস্বাভাবিক নয়। যেমন হয়েছে গোগলের বেলায়!
দ্য নেমসেক মুভির প্রধান চরিত্র কে? অসীমা (টাবু)? নাকি অশোক (ইরফান খান) নাকি গোগল (কাল পেন)? দ্বন্দ্বে পড়ে যাওয়া যায়। একজনের পাল্লা একটু ভারী হতে শুরু করলেই অন্য দুটি চরিত্র এসে যেনো ভীড় জমায়। এবং … সবাইকে ছাপিয়ে উঠে প্রধান চরিত্র হিসেবে জায়গা করে নেয় স্ট্রাগল, ক্রস কালচারাল স্ট্রাগল।
কাহিনীর শুরু সেই ১৯৭৭ সালে । অশোক যাচ্ছিলেন ট্রেনে চড়ে, পড়ছিলেন নিকোলাই গোগল। ঘটে গেল দুর্ঘটনা, পড়ে রইলেন হাত-পা ভেঙ্গে বিছানায়। কিন্তু দুর্ঘটনার আগে ট্রেনের ভদ্রলোক সেই যে বলে গেলেন দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে, তাই হয়তো সুস্থ্য হয়ে চলে এলেন আমেরিকায়। তারপর আবার বে’ করতে আসলেন ইন্ডিয়ায়, বে’ করে নিয়ে গেলেন আসীমাকে। শুরু হয়ে গেল প্রথম জেনারেশনের বাকী জীবন।
নিকোলাই গোগলের প্রতি ভালোবাসা আর পুনর্জীবন লাভ করার স্মৃতিকে বাচিয়ে রাখার জন্য প্রথম ছেলের নাম রাখা হয় গোগল, পরবর্তীতে এই নামই গোগলের জন্য যন্ত্রনা হয়ে দাড়ায়। নানা ঘটনা তাকে দ্বিধাদ্বন্দে ফেলে দেয়। কোন কালচার আকড়ে ধরবে, জন্মস্থান আমেরিকা, নাকি শেকড় ইন্ডিয়া? দোটানার একটি চিত্র ধরা পড়ে তাজমহল দেখে আর্কিটেক্ট হবার সিদ্ধান্ত দেখে।
মীরা নায়ার খুব ভালোভাবেই দুই প্রজন্মের ব্যবধান গুলো দেখিয়েছেন। যেখানে অসীমা বিয়ের আগে অশোকের জুতোয় পা ঢুকিয়েছিলেন, সেখানে গোগল বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জুড়ে নিতে পিছপা হয় না। যেখানে অসীমা আর অশোকের সম্পর্ক টিকে ছিল আমৃত্যু সেখানে গোগলের সম্পর্ক ভঙ্গে দুবার, একবার বিয়ের আগে, অন্যটি বিয়ের পরে। হয়তো সব কিছুকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে মীরা নায়ার এবং ঝুম্পা লাহিড়ি বলতে চেয়েছেন, আমেরিকা নয়, ভারতবর্ষই সেরা।
এত লম্বা সময়কে ১২২ মিনিটে ধরার চেষ্টা করা খারাপ লাগতে পারে, তবে ঘটনাপ্রবাহ সেটা ভুলতে সাহায্য করবে। আর নিজেকে বাঙ্গালী হিসেবে খুব ফিল করবেন যখন, অশোকের দেহভস্ম গঙ্গায় ছড়িয়ে দেবার সময় মাঝি গায় … … মাঝি বাইয়া যাওরে, অকূল দড়িয়ার মাঝে আমার ভাঙ্গা নাওরে মাঝি …
যারা প্রবাসে সেটলড হতে চাচ্ছেন, তারা বোধহয় একবার দেখে নিতে পারেন মুভিটি।
No comments:
Post a Comment