Sunday, October 23, 2011

**Pure Science**ব্ল্যাক হোল ( অ্যাস্ট্রোফিজিক্স)

ব্ল্যাক হোল বলতে সাধারনভাবে এমন এক ধরনের নক্ষত্রকে বোঝায় যার মহাকর্ষীয় বল এতটাই তীব্র যে মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির আলো পর্যন্ত এর মধ্য থেকে বের হতে পারে না।

ব্ল্যাক হোলের ধারণা মানুষের মনে সৃষ্টি হয় অনেক বছর আগে।কল্পকাহিনী কিংবা পৌরাণিক কাহিনীতে যেমন অনেক অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর জীব বা বস্তু পাওয়া যায় তেমনি বাস্তবেও অনেক অদ্ভুত এবং ভয় সৃষ্টিকারী বস্তুর দেখা মিলে।ব্ল্যাক হোল হল সেই রকম একটি বস্তু।ভয়ঙ্কর কিন্তু আকর্ষণীয়।ব্ল্যাক হোল এমন এক বস্তু যা থেকে আলোকরশ্মি পর্যন্ত বের হতে পারে না এবং এর ভিতরে পদার্থবিজ্ঞানের কোন সুত্র ও খাটে না।

বিখ্যাত পদার্থবিদ কিপ থর্নের ভাষায়,

“ইউনিকর্ন(এক শিং ওয়ালা ঘোড়ার মত কাল্পনিক প্রাণী) থেকে শুরু করে গার্গয়েল হয়ে হাইড্রোজেন বোমা যাই বলুন না কেন মানুষের কল্পনায় তৈরী সবচেয়ে অসাধারণ সৃষ্টি হল ব্ল্যাক হোল।মহাশূন্যের মাঝে এমন একটা গর্ত যাতে যে কোন কিছু ঢুকতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না,এমনকি আলোক রশ্মি পর্যন্ত নয়।এমন একটি গর্ত যা স্থান ও কালকে একীভূত(space-time wraping) করে।”

অনেকের কাছে এইরকম মহাজাগতিক দানবীয় বস্তুর ধারণা কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী মনে হতে পারে কিন্তু এটাই হল বাস্তবতা।থর্নের মতে “পদার্থ বিজ্ঞানের সাধারন সুত্রের সাহায্যেই দেখানো সম্ভব যে ব্ল্যাক হোল আছে এবং আমাদের গ্যালাক্সিতেই কয়েক মিলিয়ন(১ মিলিয়ন=১০ লক্ষ) ব্ল্যাক হোল থাকতে পারে। ”

যদিও আমাদের গ্যলাক্সিতে অসংখ্য ব্ল্যাক হোল থাকে তারপরও এদের পর্যবেক্ষণ করা কিংবা এদের অবস্থানসম্পর্কে জানা প্রায় অসম্ভব।কারন এরা আমাদের চোখে দেখা সম্ভব নয়।অন্ধকার তাদের আগলে রাখে(যেহেতু আলো বের হতে পারে না) তাই জোতির্বিদদের এদের খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট হয়।এই কারনেই ব্ল্যাক হোল সবার কাছে অদ্ভুত একটা বস্তু এবং একই কারনে এটা অসম্ভব রকমের আকর্ষণীয়।যেহেতু আলোও ব্ল্যাক হোল থেকে বের হতে পারে না এবং এটা দেখা ও যায় না কাজেই এর থেকে একটা বিপদের সম্ভাবনা সব সময় থেকেই যায়।সবচেয়ে বড় কথা মানুষ যতই চেষ্টা করুক না কেন যতই তাত্ত্বিক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেস্টা করুক না যে ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কি আছে বা হচ্ছে এটা আমাদের অজানাই রয়ে যাবে।এ সম্পর্কে লন্ডনের কিংস কলেজের জন টেইলর বলেছেন,

“মানুষ যখন থেকে চিন্তা করতে শিখেছে তখন থেকে তারা যে বস্তু সম্পর্কে জানতে পারবে না তার পূজা করে আসছে...সহস্রাব্দ পার হয়ে গেছে...আমরা আমাদের চারপাশ সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানতে পারছি...তারপরও আমরা আজ এমন একতা যায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে কোন জিনিস টি আমরা কখনোই জানতে পারব না বলে দেয়া যায়...যতক্ষন না আমরা আমাদের এই অবস্থায় আছি...অসম্ভভ অজানার(ultimate unknowable) একটি বিষয় হল ব্ল্যাক হোল।আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন আমরা কিছুতেই এটা(ব্ল্যাক হোল) থেকে বের হতে পারব না যদি এর ভিতরে ঢুকি।আবার আমরা যদি এর বাইরে থাকি তাহলে এর ভিতর কি হচ্ছে তা জানতে পারব না ”

সকল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটা করে দানব ব্ল্যাক হোল থাকে(জায়ান্ট ব্ল্যাক হোল) যাকে কেন্দ্র করে মাত্র এক মিলিয়ন কিলোমিটার ব্যসার্ধে কয়েক হাজার নক্ষত্র প্রবল বেগে ঘুরতে থাকে।অর্থাৎ এখানে স্টার ডেনসিটি গ্যালাক্সির অন্যান্য যায়গা থেকে প্রায় কয়েক লক্ষ গুণ বেশী।এই গতির তুলনায় আমাদের সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্র যেগুলো গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরে তাদের প্রায় স্থির ধরা যায়......

যখন আমরা ব্ল্যাক হোল বা এ জাতীয় কোন বস্তু যা অদ্ভুত এবং যা সম্পর্কে জানা প্রায় অসম্ভব সেগুলো সম্বন্ধে জানতে চাই তখন আমাদের প্রথমেই দেখতে হবে যে এটা সম্পর্কে জানা কতটা জরুরী।বা এটা সম্পর্কে জানা আদৌ দরকার কিনা...তাহলে ব্ল্যাক হোলের পেছনে বিজ্ঞানীরা যে সময়,মেধা,অর্থ ব্যয় করছেন তা কি অপচয় নয়।তারা কি এই সময়টা অন্য কোন কাজে যেটা আরও বেশী ব্যবহারিক তার পেছনে ব্যয় করতে পারতেন না???!!!এর উত্তর এক কথায় না।কারন ব্ল্যাক হোল যে মহাবিশ্বের অনেক মৌলিক প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত তার প্রমাণ প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে আমরা দেখতে পাচ্ছি...এর কারণ প্রথমত স্পষ্টতই এরা হল সাধারন মহাকর্ষের তীব্র উপস্থাপন।আর মহাকর্ষ হল সেই বল যা সমগ্র মহাবিশ্বকে একত্রে বেধে রেখেছে...আর বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষ সম্পর্কে যতই বেশী জানতে ততই তারা মহাবিশের উৎপত্তি,গঠণ এবং পরিণতি সম্পর্কে জানতে পারব।মহাশূন্যে ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি পরীক্ষা করার এটা ছিল একটা বড় কারণ।পদার্থবিজ্ঞানী মিচেল বিগলম্যান এবং মার্টিন রিস বলেন, “যেহেতু ব্ল্যাক হোল এমন একটা বস্তু যাতে মহাকর্ষ বল অন্য সব বল থেকে তীব্র তাই একমাত্র ব্ল্যাক হোলের সাহায্যেই আমরা মহাকর্ষের সকল থিওরী চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হতে পারি।”

আরো যেসব কারনে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে জানতে চায় তার মধ্যে একটি হল, অধিকাংশ ব্ল্যাক হোল সাধারন নক্ষত্রের ববর্তনের মাধ্যমে তৈরী হয়।তার মানে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে জানতে পারলে আমরা আন্তঃনাক্ষত্রিক বিবর্তন(স্টেলার ইভালিউশান) সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে পারব...জানতে পারব একটা নক্ষত্র তার শেষ পর্যায়ে এসে কিভাবে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়।এছাড়াও এখন এটাও প্রতীয়মান হ্যেছে যে গ্যালাক্সির বিবর্তনও(ইভালিউশান অফ গ্যালাক্সি) গ্যালাক্সির পরিণতি এর কেন্দ্রের দানব ব্ল্যাক হোলের জন্ম এবং জীবনচক্রের সাথে অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত।(গ্যালাক্সি হল শত কোটি(বিলিয়ন) নক্ষত্রের সমন্বয়ে তৈরী বিশাল ভরের ঘূর্ণন)

এছাড়াও এখন বিজ্ঞানীরা এটাও বিশ্বাস করেন যে ব্ল্যাক হোলের মাঝে স্পেস-টাইম(স্থান-কাল সম্পর্ক) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা সম্পর্ক থাকতে পারে।মানে আমাদের ত্রিমাত্রিক স্পেসের সাথে চতুর্থ মাত্রা সময়ের সম্পর্ক।ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি স্পেসটাইম বিচিত্র রকমের আচরণ করে।বিগলম্যান বলেন,

“কেউ যদি ব্ল্যাক হোলের ঘটন দিগন্তের খুব কাছ থেকে চারপাশে অরবিট করতে পারে তাহলে সময় তার জন্য স্থির হয়ে যাবে...ফলে সে মহাবিশ্বের পুরো ভবিষৎ দেখে ফেলবে যদিও তার কাছে সময়টা খুবি সামান্য মনে হবে...আর কেউ যদি ব্ল্যাক হোলের ঘটন দিগন্তের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে পারে...কারণ যেহেতু আমরা ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তর সম্পর্কে কখনোই জানতে পারব না...যদিও আমাদের পক্ষে এই ঘটনার ফলে বাইরে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে তা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব...”একটা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা বুঝাচ্ছি... “পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভিতর অনেক অজানা এবং অদ্ভুত জিনিস থাকতে পারে কিন্তু তা আমাদের পরমাণুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে এবং তা সম্পর্কে গণনা করতে কোন বাধার সৃষ্টি করে না...”অর্থাৎ আমরা ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কি হচ্ছে তা না জানতে পারলেও একটা ব্ল্যাক হোলের প্রভাবে তার আশে-পাশের ইউনিভার্সে কি হতে পারে তা সম্পর্কে আমরা ধারণা করত পারি...

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে,ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের বহু মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং ঘটনাপ্রবাহের সাথে সম্পর্কিত।উদাহণস্বরুপ মহাকর্ষ,স্টেলার ইভালিউশান,ফরমেশান অফ গ্যলাক্সি এবং স্পেস টাইমের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক এই ঘটনাগুলোর সাথে ব্ল্যাক হোলের সম্পর্কের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।কাজেই ব্ল্যাক হোল নামক এই গোলকধাঁধা সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে

প্রায় সবাই ব্ল্যাক হোলের কথা শুনেছেন...কিন্তু যারা বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী নন তারা কিন্তু জানেন নাই যে এই অদ্ভুত বস্তু ব্ল্যাক হোল আসলে কি করতে সক্ষম।এর একটা কারন হলো এর নামটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ব্ল্যাক হোল কিন্তু কোন গর্ত ও না আবার স্পেসে শুন্যতাও না।বরঞ্চ এটা প্রচন্ড ভরের একটা মহাজাগতিক বস্তু।যদিও ব্ল্যাক হোলে গর্ত বা সুড়ঙ্গ আছে তবে সেটা সাধারন গর্তের মত না;এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।যার মধ্যে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য মানুষের তৈরী যন্ত্রপাতির সাহায্যে নির্ণয় করা সম্ভব।যেমন উদাহরনের জন্য বলা যায় যে ব্ল্যাক হোলের প্রচন্ড ভর প্রবল মহাকর্ষ বল সৃষ্টি করে যেটা বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করতে পারেন।মহাকর্ষ হল একটা সার্বজনীন আকর্ষণ বল।কিন্তু পরমাণু,পাথরের টুকরা,মানুষ এবং ঘর-বাড়ি সবকিছুর মধ্যেই এই আকর্ষন বল কাজ করলেও তা খুবই সামান্য।এই বল এতই সামান্য যে মানুষের তৈরী কোন যন্ত্রের সাহায্যে তা নির্ণয় সম্ভব নয়।কিন্তু যদি আমরা গ্রহ-নক্ষত্রের মত বিশাল ভরের বস্তুর কথা চিন্তা করি তাহলে যেই মহাকর্ষ বল আমরা পাব তা খুবই বড় এবং যন্ত্রের সাহায্যে তা খুব সহজেই নির্ণয় সম্ভব।যেমন পৃথিবীর মহাকর্ষ চাঁদ কে তার কক্ষপথে স্থাপন করে,একইভাবে সূর্যের মহাকর্ষ পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহকে তাদের কক্ষপথে পরিভ্রমন করতে সাহায্য করে।সুতরাং একইভাবে ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র ও যে সকল বস্তু ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি থাকবে তাদের আকর্ষন করবে।এ বিষয়ে জোতির্বিদ থমাস আর্নি বলেছেন,

“একটি ব্ল্যাক হোলের তৈরি মহাকর্ষীয় বল একই ভরের অন্য একটি বস্তু থেকে কোনভাবেই আলাদা নয়।উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, যদি কোন কারনে আমাদের সূর্য হঠাৎ করে ব্ল্যাক হোলে পরিনত হয়(যেটা আসলে সম্ভব নয়) তাহলেও পৃথিবী এবং সৌরমন্ডলের অন্যান্য গ্রহ একে কেন্দ্র করে একই কক্ষপথে আবর্তন করতে থাকবে।”

একটি দূরবর্তী গ্যলাক্সির কেন্দ্রের ছবিতে ঘূর্ণায়মান গ্যাসের মেঘ...জোতির্বিদদের ধারনা এই মেঘ কেন্দ্রে থাকা একটি ব্ল্যাক হোলকে আড়াল করে রেখেছে

মহাকর্ষীয় বলের সৃষ্টিঃ

ব্ল্যাক হোল শুধু তীব্র মহাকর্ষ বলই সৃষ্টি করে না, বরং তারা এমন একটা প্রক্রিয়ার সাহায্যে সৃষ্ট হয় যে মহাকর্ষ বিশাল পরিমান পদার্থকে খুবই অল্প যায়গায় দুমড়ে-মোচড়ে দেয়।যার ফলে ব্ল্যাক হোল একটি প্রচন্ড ঘনত্বের বস্তুতে পরিণত হয়।এর ভর এবং ঘনত্ব এতই বেশী যে এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সাধারন গ্রহ নক্ষত্র থেকে অনেক অনেক গুন বেশী।বস্তুত ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতটাই তীব্র যে মহাবিশ্বের সবচাইতে দ্রুততম বস্তু আলো ও এর থেকে বের হতে পারে না।এই কারনেই ব্ল্যাক হোলকে কাল বা অন্ধকার দেখায়...কারন এর থেকে এমন কোন আলোকরশ্মি বের হয় না যা মানুষের চোখ বা টেলিস্কোপের কাছে এর অস্তিত্বের জানান দেবে।মহাকর্ষীয় বল আর ব্ল্যাক হোলের এই নিবিড় সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে এদের মহাকর্ষিয় বলের সৃষ্টি বা “ক্রিয়েচার অফ গ্রাভিটি” ও বলা হয়।কাজেই মহাকর্ষ কি এবং কিভাবে কাজ করে তা সম্পর্কে সম্যক ধারনা না থাকলে কারো পক্ষে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়...

সার্বজনীন মহাকর্ষের আবিষ্কারঃ

মহাকর্ষ বলের উপর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আসে ১৬৬৬ সালে আইজ্যাক নিউটনের কাছ থেকে।নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার আগে মানুশজের ধারনা ছিল যেই আকর্ষন বল মানুষ ,ঘর-বাড়ি , গাছ-পালা এগুলোকে পৃথিবীতে আটকে রাখে এবং যে বল পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহকে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে সহায়তা করে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন...(এই শালার জন্যই আজকে এত বই পড়তে হয়।মাঝে মাঝে চিন্তা করি নিউটনের মাথায় নারিকেল কিংবা কাঁঠাল পড়লে কি ভালোই না হইত)।মাথায় আপেল পরার পর নিউটন একখান সূত্র আবিষ্কার করলেন এবং এই সূত্রের সাহায্যে দেখালেন কিভাবে মহাকর্ষ বল কাজ করে।যেহেতু নিউটন বাঙ্গালী ছিলেন না তাই মাথায় আপেল পরার পর খাওয়ার চিন্তা না করে চিন্তা করলেন আপেল নিচে পড়ল কেন?(আফসোস)।উনি চিন্তা করলেন পাহাড়ের উপর থেকে ফেললেও যেহেতু আপেল নিচের দিকেই পড়বে সুতরাং যে বল আপেলের নিচে পড়ার জন্য দায়ী তা অনেক দূর পর্যন্ত কাজ করে।কাজেই তিনি ধারনা করলেন যে এই একই বল চাঁদকে তার কক্ষপথে আর প্রিথিবীকে সূর্যের চারপাশে তার কক্ষপথে বজায় রেখেছে।তার এই সূত্রই পরে মহাকর্ষের সার্বজনীন সূত্রে পরিনত হয়।এই সূত্র পদার্থবিজ্ঞান এবং জোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে।

বিজ্ঞানী জন গ্রিবিন বলেন;

“নিউটন আসলেই একটি সূত্রের সাহায্যে আপেলের মাটিতে পড়া আর চাদের পৃথিবীর চারপাশে পরিভ্রমন ব্যাখ্যা করেছেন।এবং এর সাহায্যে তিনি মহাজাগতিক বস্তুসমূহের গতির রহস্য সমাধান করেছেন এবং বিজ্ঞানীদের সামনে গ্রহ-নক্ষত্র এবং পুরো মহাবিশ্বের আচরণ ব্যাখ্যা করার পথ উন্মোচন করেছেন।”

আজকে ব্ল্যাক হোল নামের যে বস্তুটির সাথে আমরা পরিচিত সেটি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রেরই একটি অবদান।মহকর্ষ নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে নিউটনের পরবর্তী সময়ের অনেক বিজ্ঞানীর মাথায়ই এই প্রশ্ন আসে যে এই আকর্ষন বল উপেক্ষা করা যায় কিভাবে?নিউটনের সূত্রের সাহায্যে দেখা যায় পৃথিবী তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরে এবং সূর্যের আকর্ষনে কেন সূর্যের দিকে সরে যায় না।কারন হল পৃথিবী সুর্যের কাছ থেকে সেই বেগে ছুটে যাচ্ছে যা ঠিক সূর্যের আকর্ষন বলের সমান।ফলে দুটি বল পরস্পরকে ব্যালেন্স বা সমতা সাধন করছে।কিছু বিজ্ঞানী (ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো টাইপ) চিন্তা করল যদি কোন আকাম কইরা পৃথিবীর স্পিড বাড়িয়ে দেয়া যায় তাইলে কি হইব?যুক্তি দিয়া চিন্তা করলে তখন পৃথিবী সুর্যের আকর্ষন ছিন্ন করবে...অর্থাৎ আকর্ষন থেকে মুক্তি পাবে...

যেই বেগে কোন বস্তু চললে তা অন্য একটা বস্তুর মহাকর্ষ বল থেকে মুক্ত হতে পারে তাকেই বলা হয় মুক্তি বেগ...উদাহরন্স্বরুপ বলা যায় পৃথিবীর মুক্তি বেগ ১১.২ কিমি/সেকেন্ড(প্রায়)।যার মানে হল রকেট বা কোন মহাকাশ যানকে পৃথিবীর আকর্ষন মুক্ত হয়ে মহাশুন্যে যেতে হলে কমপক্ষে এই গতিতে ছুটতে হবে।অন্যদিকে এই বেগের কোন রকেট বৃহস্পতির আকর্ষন থেকে কখনোই মুক্ত হতে পারবে না কারন বৃহস্পতির ভর পৃথিবী থেকে বেশী ফলে মহাকর্ষ বলও।অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীর(গ্রহের) জন্য মুক্তি বেগ ভিন্ন হবে।বিখ্যাত কল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাস লেখক আইজ্যাক আজিমভ বলেন,

“পৃথিবী থেকে কম ভরের গ্রহের পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ কম আর বেশী ভরের গ্রহে বেশী...কাজেই সৌরজগতে বৃহস্পতির পৃষ্ঠে মুক্তিবেগ বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক...প্রকৃতপক্ষে তা পৃথিবীর ৫.৪ গুন...”

অষ্টাদশ শতাব্দীতে কিছু বিজ্ঞানী অধিক ভরের বস্তু যাদের মুক্তিবেগ আরো অনেক বেশি এমন বস্তু নিয়ে চিন্তা করা শুরু করেন।এই বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন হলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন মিচেল(সিসমোলজির বা ভূমিকম্পবিদ্যার জনক,বাইনারি স্টার ধারনার প্রবর্তক),যিনি নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন।এটা তখনই পরিষ্কার হয় যে মহাবিশ্বে সূর্যের থেকেও ভারী নক্ষত্র আছে।নক্ষত্রের ভরের কোন উচ্চসীমা আছে কিনা তা মিচেল জানতেন না।কিন্তু তিনি প্রস্তাব করলেন যে,তাত্ত্বিকভাবে বিশাল ভরের নক্ষত্র থাকতে পারে যার মহাকর্ষ বল অত্যন্ত তীব্র।তাছাড়া এই সব দানব নক্ষত্রের মুক্তিবেগও অনেক বেশী হবে।মিচেল চিন্তা করলেন একটি নক্ষত্রের মুক্তি বেগ তাহলে সর্বোচ্চ কত হতে পারে??এই যুক্তির সাহায্যে তিনি চিন্তা করলেন যে যদি কোন নক্ষত্রের মুক্তি বেগ ১৮৬০০০ মাইল/সেকেন্ড এর থেকে বেশী হয় তাহলে কি হবে?এই যুক্তির সাহায্যে তিনি বললেন যে, আলোও এই সব নক্ষত্র থেকে বের হতে পারবে না।১৭৮৪ সালে প্রকাশিত একটি পেপারে তিনি বললেন, “যদি মহাবিশ্বে এমন কোন বস্তু থেকে থাকে যার ব্যাসার্ধ আমাদের সূর্য থেকে ৫০০ গুন বেশি,তাদের প্রবল শক্তিশালী মহাকর্ষ বল থাকবে এবং এই বস্তুর মুক্তিবেগও অনেক বেশী হবে।ফলে এইসব বস্তু থেকে বের হওয়া আলোকরশ্মি এদের মহাকর্ষের টানে ওই বস্তুতেই ফিরে আসবে।আর যেহেতু আলো এই বস্তু থেকে বের হতে পারবে না কাজেই আমরা দৃষ্টিশক্তির সাহায্যে এ ধরনের বস্তুর কোন তথ্য পাব না।অন্যভাবে বলতে গেলে, এই নক্ষত্রগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে...ফলে আমরা চোখ বা টেলিস্কোপের সাহায্যে তাদের দেখতে পাব না।কাজেই মিচেল এই বস্তুগুলোর নাম দেন ‘ডার্ক স্টার’। ”

প্রকৃতপক্ষে তার সময়ে মিচেলই একমাত্র বিজ্ঞানী নন যিনি তীব্র মহাকর্ষ বলের প্রভাব নিয়ে প্রবল্ভাবে আকর্ষিত হয়েছিলেন।১৭৯৫ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে সাইমন ল্যাপলাসও স্বতন্ত্রভাবে একই উপসংহারে আসেন।তিনি লিখেন, “মহাবিশ্বে কোথাও না কোথাও নক্ষত্রের সংখ্যার মত বিশাল সংখ্যায় এমন বস্তু(নক্ষত্রের ন্যায়) থাকতে পারে যার ঘনত্ব হয়তো আমাদের পৃথিবীর ঘনত্বের মতই কিন্তু ব্যাস আমাদের সূর্যের প্রায় আড়াইশ গুন বেশি।এইসব বস্তু তাদের প্রবল আকর্ষন(মহাকর্ষ) বলের কারনে তাদের মধ্য থেকে কোন রশ্মিকেই(আলোক) বের হতে দেয় না।এই কারণেই হয়তবা মহাবিশ্বের সবচাইতে উজ্জ্বলতম এই বস্তুটি আমাদের অদেখাই রয়ে গেছে।”

এই উপসংহারের উপর ভিত্তি করে ল্যাপলাস এই বস্তুগুলোর নাম দেন ‘লেস কর্পস অবসকিউরস’ বা ‘অদৃশ্য বস্তু’

মজার বিষয় হল মিচেল এবং ল্যাপলাস যখন ব্ল্যাক হোল ধারনার প্রবর্তন করেন তখন হাইগেনস এর আলোর তরঙ্গতত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত।পরবর্তীকালে অবশ্য প্রমানিত হয়েছে আলো আসলে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ।আমরা জানি কন বস্তু যার ভর আছে কেবল্মাত্র তাই মহাকর্ষ বল দ্বারা আকৃষ্ট হবে...আমরা এটাও জানি যে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গের(যেমন দৃশ্যমান আলো) কোন ভর নাই।তাহলে কিভাবে আলো মহাকর্ষের দ্বারা আকৃষ্ট হয়।

বিজ্ঞানী মিচেল এবং ল্যাপলাস যে ডার্ক স্টারের বর্ণনা সেন তাছিল সম্পুর্ণ তাত্ত্বিক।এই ধরনের মহাজাগতিক বস্তুর অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই ছিল না...এবং সেই সময়ের অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের ধারনা ছিল যে মহাবিশ্বে এই ধরনের কোন নক্ষত্রের অস্তিত্ত্ব নেই।হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রায় কয়েক হাজার ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করা হলেও এখনো অনেকেরই ধারনা ব্ল্যাক হোল বলে কিছু নেই।আমার দুই একজন বন্ধুকেও এটা বিশ্বাস করতে দেখেছি।স্বভাবতই এই ধারনা তখন শুধুমাত্র গানিতিক আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।অর্থাত এ ধরনের নক্ষত্রের ভর কত হতে হবে কিংবা এদের মধ্যে পদার্থের ঘনত্ব কত হবে এই ধরনের কাল্পনিক গননাতেই ব্ল্যাক হোলের ধারনা থেমে ছিল...যার ফলে পরবর্তি এক শতাব্দিরও বেশী সময় ধরে বিজ্ঞানীরা এই ধারনাটা নিয়ে তেমন একটা কাজ করেননি...

বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে আলবার্ট আইন্সটাইন যখন তার মহাকর্ষের একটি নতুন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন তখন ব্ল্যাক হোলের ধারনাটি আবার পূণর্জাগরণ পায়।১৯১৫-১৯১৬ সালে প্রকাশিত থিওরী অফ রিলেটিভিটির একটি অংশে তিনি এই প্রস্তাবটি করেন।এটার মাধ্যমে তিনি নিউটনের সার্বজনীন মহাকর্ষীয় সুত্রকে ভুল প্রমান করেন নি বরং এর মাধ্যমে তিনি স্পেসের(স্থান) প্রকৃতি এবং মহাকর্ষ কিভাবে স্পেসে ক্রিয়া করে তা নিউটন থেকে আলাদাভাবে দেখান।

উদাহরনস্বরুপ নিউটনের মতে মহাকর্ষ বল শুধুমাত্র বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া করে এবং কোনভাবে এর কেন্দ্র থেকে ক্রিয়া করে।অন্যদিকে আইনস্টাইনের মতে মহাকর্ষ কোন দিকধর্মী বল নয় বরং তা স্পেসের একটি বৈশিষ্ট্য।একটি যুগান্তকারী ধারনা যা প্রস্তাব করে যে স্পেসের একটি নিজস্ব কাঠামো আছে।আইনস্টাইনের পূর্বে পদার্থবিদদের ধারনা ছিল যে স্পেস বা মহাশুন্য একেবারেই ফাঁকা বা শুন্য এবং স্পেসে গতিশীল কোন বস্তুর উপর এর কোনই প্রভাব নেই।অন্যদিকে আইনস্টাইন বলেন যে স্পেস এক ধরনের অদৃশ্য ফেব্রিক দিয়ে তৈরী যা স্থিতিস্থাপক(ইলাস্টিক) এবং বক্রতার উপযোগী(বেন্ডেবল)।

আইনস্টাইন আরো বলেন যে, ভর আছে এমন যে কোন বস্তু স্পেসে সঞ্চরমান(মুভ করলে) হলে তা এই অদৃশ্য ফেব্রিকের মাঝে ডুবে গিয়ে বা ভিতরে প্রবেশ করে স্পেসে এক অদৃশ্য গর্ত তৈরী করে স্পেসের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে।বিজ্ঞানীরা এই কুয়াসদৃশ গর্তকে বলেন ‘গ্রাভিটি ওয়েল’ বা মহাকর্ষ কূপ।এই মহাকর্ষ কূপ এর গভীরতা নির্ভর করে বস্তুর ভরের উপর অর্থাৎ ভর যত বেশি হবে কূপ বা গর্ত ততই গভীর হবে।এইভাবেই গ্রহ নক্ষত্রের মত অত্যধিক ভরসম্পন্ন বস্তুগুলি তাদের কাছাকাছি স্পেসের অদৃশ্য ইলাস্টিক ফেব্রিকটাকে বিকৃত করে বা বাকিয়ে দেয় এবং এই বক্রতাই হল আমরা যেটাকে মহাকর্ষ বলি বা মহাকর্ষ হিসেবে অনুভব করি।

এই ব্যাপারটা সহজভাবে এভাবে বলা যায় যে... “আমি যদি একটা ফোমের খাট নেই যেটা সাধারনভাবে সমতল এবং তারপর এতে একটা ক্রিকেট বল(কাঠের) রাখি তাহলে যেখানে বলটা রাখলাম সেখানটায় কিছুটা ডেবে যাবে...এখন আমরা যে অংশটা ডেবে গেছে সেখানে যদি একটা মার্বেল রাখি তাহলে মার্বেলটা একটা সর্পিল(স্পাইরাল) পথ অনুসরন করে ক্রিকেট বলটার দিকে এগিয়ে যাবে বা আকর্ষিত হবে।অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক বক্রতার জন্য ক্রিকেট বল আর মার্বেলের মধ্যে এক ধরনের আকর্ষনের উদ্ভব হয়েছে।এখন আমি যদি ক্রিকেট বল না নিয়ে একটা বেসবল বা বাস্কেটবল নেই তাহলে ফোমটা আরও বেশী ডেবে যাবে এবং এক্ষেত্রে মার্বেল নিলে তা আগের চেয়ে দ্রুত কেন্দ্রের দিকে গতিশীল হবে।অর্থাৎ এটা দাঁড়ায় যে, পারিপার্শ্বিক বক্রতার উপর বস্তুর আকর্ষনের তীব্রতা নির্ভর করে।মহাকর্ষও ঠিক এভাবেই কাজ করে,অর্থাৎ জেনারেল থিওরী অফ রিলেটিভিটির মতে,ভর মহাশুন্য বা স্থান বা স্পেসে বক্রতা বা কার্ভেচার তৈরী করে আর বস্তু যখন এই কার্ভেচারে গতিশীল হয় তখনই মহাকর্ষীয় গতির উদ্ভব হয়।”

এখন আমরা উপরের উদাহরনের সাথে মহাজাগতিক বস্তুর গতির তুলনা করি।মনে করি ভিন্ন ভরের দুইটি গ্রহ পরস্পরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।তাহলে ছোট গ্রহটা বড় গ্রহের মহাকর্ষ কূপের গর্তের প্রভাবে বড় গ্রহের দিকে নিম্নমুখী গতি লাভ করবে।(এটা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের মতই ঘটনা যে বড় বস্তু ছোট বস্তুকে তার দিকে টেনে নেয়।তাই নিউটনের সূত্র এখানেও প্রয়োগ করা যাবে এবং অধিকাংশ বস্তুর ক্ষেত্রেই এটি যুক্তিপূর্ণ।)।আইন্সটাইনের মহাকর্ষ মডেলে ছোট গ্রহটি যদি পর্যাপ্তভাবে দ্রুতগতিতে ঘুরতে থাকে তাহলে তা বড় গ্রহের মহাকর্ষ কুপ থেকে বের হয়ে আসবে এবং এর নিজস্ব গতিপথে চলতে থাকবে।অন্যদিকে এটা যদি এই মুক্তিবেগের থেকে কম গতিতে চলে তাহলে এটি বড় গ্রহটির মহাকর্ষ কূপে আটকা পড়বে এবং হয় এটি বড় গ্রহকে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন করতে থাকবে অথবা বড় গ্রহটিতে আছড়ে পড়বে...

আইন্সটাইনের মহাশুন্যের বক্রতার(কার্ভেচার অব স্পেস) নতুন তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের মহলে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি করল।অনেক পদার্থবিদ,জোর্তিবিজ্ঞানী ধারনা করলেন আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব জোর করে মিলানোর একটা চেস্টা মাত্র তাই তারা এই তত্ত্বকে পরীক্ষার সাহায্যে প্রমান করে দেখতে চাইলেন।তারা বললেন স্পেস যদি স্ত্যিই বক্র হয় এবং যদি বিশাল ভরের বস্তুসমূহ সত্যিই স্পেসে মহাকর্ষ কূপ তৈরি করে তাহলে একটা প্রচন্ড গভীর মহাকর্ষ কূপ আলোকরশ্মিকে বাকাতে পারবে।অন্যকথায় বলা যায়, যদিও আলো এই মহাকর্ষ কূপকে অতিক্রম করার জন্য প্রয়োজনীয় মুক্তিবেগের থেকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলে তারপরও এই কূপ আলোক-রশ্মিকে বিজ্ঞানীদের পরিমাপ করার মত পরিমান বাকাতে পারবে।

এই পরীক্ষার জন্য যা দরকার ছিল তা হল একটা প্রচন্ড ভরসম্পন্ন বস্তু(অন্ততপক্ষে মানুষের পরিমাপের স্কেলে)।এবং সঙ্গত কারনেই সৌরজগতের সবচাইতে ভারী বস্তু হওয়ায় সূর্যই ছিল সবচাইতে গ্রহনযোগ্য বস্তু।এই ঐতিহাসিক পরীক্ষা অবশেষে ১৯১৯ সালের ১৯ শে মে মধ্য-আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে দেখতে পাওয়া সূর্যগ্রহনের সময় সংঘটিত হয়।গ্রহনে ঢাকা পড়া্র পর সূর্যের পাশের উজ্জ্বল তারাগুলি তখন দেখা যাচ্ছিল।আইজ্যাক আজিমভ বলেন, “আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভবিষ্যতবানী অনুসারে এই সময় যখন এই তারাগুলির আলো পৃথিবীর দিকে আসতে যাবে তখন সূর্যের কাছাকাছি অংশ দিয়ে যে আলোকরশ্মিগুলো আসবে তা সূর্যের দিকে সামান্য বেকে যাবে।”সূর্যগ্রহনের সময় সংগ্রহকৃত ডাটা গুলো বিশ্লেষন করার পর দেখা গেল সত্যিই দূরবর্তী তারাগুলোর আলো সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চিতভাবে সামান্য বেকে গেছে।এবং এই বেকে যাওয়া আইন্সটাইনের সূত্রানুসারে ভবিষ্যতবানীকৃত পরিমানের প্রায় সমান।ই পরীক্ষার মাধ্যমে আইন্সটাইনের মহাশুন্যের বক্রতা আর মহাকর্ষ কূপের তত্ত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।এছাড়াও আরো কয়েকটা পরীক্ষার মাধ্যমে আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি তখন সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে।থিওরী অব রিলেটিভিটি বিজ্ঞানীদের চরমমাত্রার মহাকর্ষের প্রভাব নিয়ে করা মিচেল,ল্যাপ্লাসদের ভবিষ্যতবানী নিয়ে আবার ভাবিয়ে তুলল...(খাইয়া কাম না থাকলে যা হইয় আর কি)।সূর্যগ্রহন এর সময় করা পরীক্ষা থেকে দেখা গেল সূর্যের মহাকর্ষ কূপ আলোকে সামান্য বাকিয়ে দেয়।তাহলে আরো অনেকগুন বেশি ভরসম্পন্ন বস্তু আলোক্রশ্মিকে আরো বেশি পরিমান বাকাবে।এবং স্বাভাবিকভাবে এই ঘটনা সুপারম্যাসিভ বা সুপারডেন্স বস্তুর তাত্ত্বিক সম্ভাবনার দিকেই আমাদের ঠেলে দেয়।এবং যদি এমন বস্তু থাকে তাহলে তার অত্যন্ত গভীর মহাকর্ষ কূপ থাকবে, হয়তো এতই গভীর যে আলোও তার থেকে বের হতে পারবে না।১৯৩৯ সালে বিখ্যাত পদার্থবিদ রবার্ট ওপেনহেইমার ও তার ছাত্র জর্জ ভলকফ একটি সাইন্টিফিক পেপার প্রকাশ করেন যাতে তারা এমন একটি সুপারডেন্স নক্ষত্রের ভবিষ্যতবানী করেন যার মহাকর্ষ কূপ অতল(অসীম গভীরতা সম্পন্ন বা বটমলেস)।

তখন পর্যন্ত এমন অদ্ভূত মহাজাগতিক বস্তুর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।কাজেই পরবর্তী বছরগুলোতে ডার্ক স্টার এবং স্পেস ও আলোর উপর এদের সম্ভাব্য অস্বাভাবিক প্রভাব শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং মুভির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল।এই ধারনার সাথে সম্পৃক্ত প্রথম চেষ্টাটি ছিল ১৯৬৭ সালে প্রচারিত স্টার ট্রেক(অরিজিনাল) টিভি সিরিয়ালে।স্টার ট্র্যাক সিরিয়ালের ক্যাপ্টেন কার্ক এবং তার ক্রু রা যে অদ্ভুত বস্তুর মুখোমুখি হন তার নাম দেন “ডার্ক স্টার” যেটা প্রফেটিক(prophetic) হয়ে যায়।যে সময়ে হাতে গোণা কয়েকজন পদার্থবিদের মধ্যে এই ধরনের বস্তুর ধারনা পুণঃর্জাগরিত হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে স্টার ট্র্যাকের এই পর্বটি প্রচারিত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত পদার্থবিদ জন হুইলার প্রথমবারের মত “ব্ল্যাক হোল” শব্দটির অবতারনা করেন।নামটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনেকটাই এই ধরনের বস্তুর বর্ণনামূলক হওয়ায় এটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে।এবং এর পর থেকেই ব্ল্যাক হোল এর ধারনা অধিক পরিমানে পদার্থবিদ,জোর্তিবিদ ও আন্যান্য বিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞান ভক্তদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠে।জন হুইলারই পরবর্তীতে এ সম্পর্কে বলেন...

“১৯৬৭ সালে ‘ব্ল্যাক হোল’ শব্দের অবতারনা পারিভাষিক দিক থেকে গুরুত্বহীন হলেও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ছিল অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ।এই নাম দেয়ার পর থেকেই নতুন করে অনেক জোর্তিবিদ এবং জোর্তিপদার্থবিদের মাঝে এ ধারনা তৈরি হতে লাগল যে ব্ল্যাক হোল কোন কল্পনাপ্রসূত বস্তু নয় বরং এ ধরনের বস্তু খোঁজার পিছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করা দরকার।”

বস্তুতই সময় এবং অর্থ ব্ল্যাক হোলের রহস্য উন্মোচনে বড় একটা নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়।প্রায় দুইশ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের এই বস্তুর ভবিষ্যতবানী ছিল এর প্রথম ধাপ।পরবর্তী আবশ্যক ধাপ বা লক্ষ্য হল একাগ্রচিত্তে বা পূর্ণ মনযোগের সাথে এই ধারনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা...যার মধ্যে রয়েছে এই বস্তুগুলো কিভাবে তৈরি হয়???এবং কিভেবে এদের সনাক্ত করা যায়???ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে ধারাবাহিক অনেকগুলো অসামান্য গবেষনা ও তার ফলাফলের ভিত্তিতে এই লক্ষ্যের অনেকটাই পূরণ হয়েছে এবং এর সাহায্যে মানুষের মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারনার আমূল পরিবর্তন হয়েছে...

1 comment:

ওয়ানপ্লাসের নতুন অক্সিজেন ওএস ১৫ আসছে AI নিয়ে

  অ্যান্ড্রয়েড ১৫  এর ওপর ভিত্তি করে আসছে  ওয়ানপ্লাসের  অক্সিজেন    ওএস  ১৫। অক্টোবরের ২৪ তারিখ বাংলাদেশ সময় রাত ৯:৩০ এ আনুষ্ঠানিকভাবে অপ...