Saturday, November 26, 2011

ঈসা (আঃ) এর মৃত্যু

ঈসা (আঃ) এর মৃত্যু

নুযূলে মসীহ্‌ নবীউল্লাহ্‌


মসীহ্‌ বিভ্রাট

সহী হাদীস পাঠে জানা যায় যে, আখেরী জামানায় যখন মুসলমান জাতি অধঃপতনের চরম স্তরে গিয়ে পৌঁছবে, সারা বিশ্বে বিকৃত খ্রীস্টান ধর্ম প্রসার লাভ করবে এবং সমগ্র জগতে যখন ব্যাপকভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে থাকবে তখন ক্রুশীয় মতবাদকে বাতিল এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ রহিত করে বিশ্বে শান্তি স্থাপন করবার উদ্দেশ্যে মসীহ্‌ নবীউল্লাহ্‌ আগমন করবেনতাঁর শুভাগমনে ইসলাম নব জীবন লাভ করে সারা দুনিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত হবেএ সম্বন্ধে কয়েকটি হাদীস হলঃ

  • (১) ইউশেকুমান আশামিনকুম আইয়ালকা ঈসাবনা মারয়ামা ইমামান মাহ্দীয়ান ওয়া হাকামান আদলান ফাইয়াক সেরুসসালীবা ওয়া ইয়াকতুলুল খিনজিরা ওয়া ইয়াযায়াল হারবা(মসনদ আহ্‌মদ হাম্বল, জিল্‌দ-২, পৃঃ৪১১) অর্থঃ- তোমাদের (মুসামানদের) মধ্যে (তখন) যারা জীবিত থাকবে তারা অচিরেই ঈসা ইবনে মরিয়ম রূপে ইমাম মাহ্‌দীকে ন্যায়-বিচারক মীমাংসাকারীরূপে আসতে দেখবেতিনি ক্রুশ ভঙ্গ করবেন, শূকর বধ করবেন ও যুদ্ধ রহিত করবেন
  • (২) কাইফা তাহ্লেকু উন্মাতুন আনা ফি আউয়ালিহা ওয়াল মাসীহু ফি আখিরিহা(মেশকাত ও জামেউসসাগীর সাইউতি, জি-২, পৃঃ ১০৬) অর্থঃ- কি করে ধ্বংস হবে আমার উম্মত যার প্রথম দিকে আমি রয়েছি এবং শেষ দিকে মসীহ রয়েছেন
  • (৩) কাইফা আনতুম ইযা নাযালাবনু মারয়ামা ফিকুম ওয়া ইমামুকুম মিনকুম(বোখারী)অর্থঃ- কেমন হবে তখন যখন ইবনে মরিয়ম নাযিল হবেন, তোমাদের মধ্য হতে তোমাদেরই ইমাম হয়ে?

এ ধরণের আরও বহু রেওয়ায়াত হাদীস গ্রন্থে বিদ্যমান আছে

এই প্রতিশ্রুত ঈসা নবীউল্লাহ্‌র আগমন সম্বন্ধে যদিও সমগ্র উম্মত একমত, কিন্তু শেষ যুগে ইসলাম-তরীর কর্ণধার এই মহাপুরুষের সত্য পরিচয় সম্বন্ধে যথেষ্ঠ ইখতেলাফ রয়েছেগয়ের আহ্‌মদীগণ বলেন, এই প্রতিশ্রুত মসীহ্ নবীউল্লাহ্ হলেন বনীইস্রাঈলী নবী হযরত ঈসা (আঃ)কিন্তু আহ্‌মদী জামা'ত নিম্নবর্ণিত কারণে এই বিশ্বাসের সমর্থন করেন না

ঈসা (আঃ) মৃত

ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু সম্বন্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত আছেযথা-

  • ইহুদীদের বিশ্বাসঃ ইহুদীদের বিশ্বাস এই যে, ঈসা (আঃ) নবুওয়তের মিথ্যা দাবীদার ছিলেনএ জন্য তৌরাতের ব্যবস্থা (দ্বিতীয় বিবরণ- ২১:২৩ দ্রষ্টব্য) অনুযায়ী তাঁকে শূলে দিয়ে অভিশপ্ত করে বধ করা হয়েছে
  • খ্রীস্টানদের বিশ্বাসঃ খ্রীস্টানরা বিশ্বাস করে যে, ঈসা (আঃ) খোদার পুত্র ছিলেনতিনি পাপী মানব জাতির পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য শূলে অভিশপ্ত মৃত্যুবরণ করে তিন দিন পর পুনরায় জীবিত হয়ে আকাশে উঠে খোদার দক্ষিণ পার্শ্বে বসে আছেন- (ইব্রীয়- ৯:২৭,২৮, মার্ক-১৬:১৯ দ্রষ্টব্য)
  • গয়ের আহ্‌মদীদের বিশ্বাসঃ গয়ের আহ্‌মদীদের বিশ্বাস এই যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর এক নবী ছিলেনতাঁকে ইহুদীগণ শূলে দিয়ে বধ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আল্লাহ্ তাঁকে উঠিয়ে চতুর্থ আকাশে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছেনআর ঈসা (আঃ)-এর আকৃতি বিশিষ্ট অন্য এক ব্যক্তিকে শূলে দিয়ে বধ করেছে
  • আহ্‌মদীদের বিশ্বাসঃ আহ্‌মদীগণ বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ্‌র নবী ঈসা (আঃ)-কে ইহুদীরা অভিশপ্ত করে বধ করবার জন্য শূলে দিয়েছিলকিন্তু তিনি শূলে প্রাণত্যাগ করেন নিশিষ্যদের চেষ্টা মুর্ছিত অবস্থায় শূল থেকে নামবার পর বহু বৎসর জীবিত থেকে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন

কোরআনের কষ্টি পাথরে

আমরা এখন কোরআনের আলোকে আলোচনা করে দেখব যে, এই চার প্রকার বিশ্বাসের মধ্যে কোন্‌টি সত্য

পবিত্র কোরআনের সূরা নেসার ২২ রুকূতে আল্লাহ্ তাআলা ইহুদীদের দাবী উল্ল্যেখ করে বলেন, ‘ওয়া কাউলিহিম ইন্না কাতাল নাল মাসীহা ঈসাবনা মারয়ামা রাসূলাল্লাহি’- অর্থাৎ ‘(ইহুদীগণ) বলে আমরা বধ করেছি আল্লাহ্‌র রসূল (হওয়ার দাবীদার) মরিয়ম পুত্র মসীহ্‌কেএর প্রতিবাদে আল্লাহ্ বলেন, ওয়া কাতালুহু ওয়াম সাবাবুহু ওয়াকিন শুব্বিহা লাহুম, অর্থঃ- তারা (ঈসাকে) কতল করে নাই, শূলে দিয়েও বধ করে নাই তবে তদ্রুপই অর্থাৎ মৃতবৎ মনে হয়েছিলএই আয়াতে ইহুদী এবং খ্রীষ্টানদের ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন করে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন যে, ইহুদীরা ঈসাকে হত্যা করতে পারেনি এবং শূলে দিয়ে অভিশপ্তও করতে পারেনি, তবে শূলে ঈসাকে মৃত মনে করা হয়েছিলকেউ কেউ বলেন, “ওমা সালাবুহুবাক্য দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈসা (আঃ)-কে শূলে দেয়া হয়নিকিন্তু তা ঠিক নয়, কেননা, আরবীতে সালাবাশব্দ শূলে দিয়ে মারা এবং হাড় চুর্ণ করা অর্থে ব্যবহৃত হয় (আরবী অভিধান দ্রষ্টব্য)বাংলাতেও এরূপ ব্যবহার আছেযেমন, যদি বলা হয় অমুক ব্যক্তির ফাঁসী হয়নি তবে এর অর্থ হবে, ঐ ব্যক্তির ফাঁসীতে মৃত্যু হয়নিকোন ব্যক্তিকে ফাঁসীকাষ্ঠে উঠিয়ে আবার নামিয়ে দিলে তাকে ফাঁসী হওয়া বলে নাআরবীতে সালাবার ব্যবহারও এইরূপঅতএব ওমা সালাবুহুদ্বারা প্রমাণ হয় যে, ঈসা (আঃ)-এর শূলে মৃত্যু হয়নিএবং তাঁর হাড়ও চুর্ণ হয় নাই (যোহন- ২৯:৩৬ দ্রষ্টব্য) এর কয়েক আয়াত পর আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন, ‘বার্রাফা হুল্লাহু ইলাইহীঅর্থঃবরং আল্লাহ্ উদ্ধরণ করেছেন (ঈসাকে) নিজের দিকেএই আয়াতকে সম্বল করে একদল লোক ঈসা (আঃ)-এর আকাশে জীবিত থাকা বিশ্বাস করেঅথচ, এই আয়াত দ্বারা কোন প্রকারেই তাঁর আকাশে উঠা প্রমাণ হয় নাইহুদীগণ ঈসা (আঃ)-কে শূলে বধ করে অভিশপ্ত প্রমাণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ্ তাঁকে এই প্রকার মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছেন এবং আত্মিকভাবে নিজের দিকে উন্নীত করেছেন আরবী রাফাশব্দ দ্বারা কেবল দৈহিকভাবে উপরে উঠান বুঝায় না, বরং এর দ্বারা আত্মিক উন্নতিও বুঝিয়ে থাকেপবিত্র কুরআন ও হাদীসে এই জাতীয় বহু ব্যবহার বিদ্যমান রয়েছে বালয়াম বাউর সম্বন্ধে সূরা আরাফের বাইশ রুকুতে আল্লাহ্ বলেন, ‘ওয়াওশিনা লারাফানাহু বিহা ওলা কিন্নাহু আখলাদা ইলাল আরযেঅর্থঃ আর আমরা যদি চাইতাম তা হলে তাকে উন্নীত করতাম কিন্তু সে মর্ত্যের দিকে ঝুকে গেলএখানে রাফাঅর্থ কেউই আকাশে উঠা করবে নাসূরা মরিয়মের চার রুকূতে আল্লাহ্ ইদ্রীস (আঃ) সম্বন্ধে বলেন, ‘ওয়া রাফানাহু মাকানান আলীয়াঅর্থঃ আমি তাকে এক উচ্চ মকামে উন্নীত করেছিলামএখানেও রাফাদ্বারা সশরীরে উর্ধ্বে উঠা বুঝায় নাসূরা নূরের পঞ্চম রুকুতে আছে, ‘ফি বুয়ুতিন আজিনাল্লাহু আন তুরায়া ওয়া ইউয কারা ফি হাসমুহুঅর্থঃ (আল্লাহ্‌র নূর) এমন ঘরগুলিতে আছে, যেগুলির উন্নতির আদেশ আল্লাহ্ দিয়েছেন

সহী মুসলিম শরীফে আছে, ‘ওমা তওয়াজায়া আহাদুনলিল্লাহি ইল্লা রাফ��য়াল্লাহ্ অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র জন্য বিনয়ী হয় আল্লাহ্ তাকে উন্নীত করেনএই হাদীসে প্রত্যেক বিনয়ী এবং নম্র মুমিনের রাফাহবে বলে রসূল করীম (সাঃ) বলেছেন অথচ, ঈসা (আঃ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাঁকে নিজের দিকে রাফাকরেছেন

আমরা সকলেই জানি আল্লাহ্ অসীম ও নিরাকারতিনি সর্বত্র বিরাজমানপবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ বলেন, ‘ওয়া নাহনু আকরাবু ইলাইহী মিন হাবলিল অরিদঅর্থৎ আমি মানুষের জীবন শিরা থেকেও নিকটে (কাফ, রুকূঃ ২)ওয়া হুয়া মায়াকুম আইনামা কুনতুমঅর্থঃ তোমরা (সৃষ্টি) যেখানে আমিও সেখানে, (হাদীদ, রুকুঃ ১) ওয়াসিয়া কুরসিউহুস সামাওয়াতে ওয়াল আরযেঅর্থঃ আল্লাহ্‌র অবস্থিতি গগন-ভুবন ব্যাপীয়া, (বাকারা, রুকূঃ ৩৪)হাদীসে আছে, ‘কুলুবুল মুহমিনীনা আরশুল্লাহঅর্থঃ বিশ্বাসীর অন্তরে আল্লাহর আসনঅতএব, আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেওয়ার অর্থ আকাশে উঠান কখনও হতে পারে নাআল্লাহর দিকে উদ্ধরণ অর্থে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা বুঝায়যেমন, কোরআনের অন্যত্র ঈসা (আঃ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘ওয়ামিনাল মুকাররাবিনঅর্থাৎ ঈসা নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্গত (আলে ইমরান, রুকূঃ ৫)

মানুষ আকাশে যেতে পারে না

সূরা বনী ইসরাঈলের দশ রুকূ পাঠে জানা যায় যে, কাফেরগণ আঁ হযরত (সাঃ)-কে কতিপয় অলৌকিক কার্য করে দেখাতে বলেছিলতন্মধ্যে একটি ছিল আউ তারকা ফিসসামায়ীবা তুমি আকাশে উঠে দেখাওএর উত্তরে আল্লাহ্ তাআলা আঁ হযরত (সাঃ)-কে বললেন, ‘কুল সুবহানা রাব্বি হাল কুনতু ইল্লা বাশারার্রাসুলা’, অর্থঃ তুমি এদেরকে বলে দাও যে, আমার প্রভু এই সকল (অনর্থক কার্য করা) থেকে পবিত্র, আর আমি মানুষ রসূল ব্যতিরেকে অন্য কিছু নইঅর্থাৎ মানুষ রসূলের পক্ষে এই সকল কাজ করা আল্লাহ্‌র নীতি বিরুদ্ধএই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, কোন মানুষের পক্ষে যদিও বা তিনি, আল্লাহ্‌র রসূল হন তবুও আকাশে যাওয়া পবিত্র খোদার আইন বিরুদ্ধঅতএব, পবিত্রময় প্রভুর পক্ষে তাঁর এই আদেশের খেলাফ কাকেও আকাশে উঠান সম্ভবপর নয় ওলা তাজিদু লিসুন্নাতিনা তাহবিলা(বনী ইসরাঈল, রুকূঃ ৮)অর্থাৎ আল্লাহ্‌র নিয়মের কখনও ব্যতিক্রম হয় না

কোরআনে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু প্রমাণ

ইহুদীরা যখন ঈসা (আঃ)-কে শূলে দিল তখন তিনি এই অভিশপ্ত মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাতরভাবে প্রার্থনা করতে লাগলেন, এলী এলী লামা সবক্তানী (মথি- ২৭:৪৬ দ্রষ্টব্য)

আল্লাহ্ তাআলা ঈসা (আঃ) কে সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ ইয়া ঈসা ইন্নি মুতাওওয়াফফিকা ওয়া লাফেউকা ইলাইয়া ওয়া মুতাহহেরুকা মিনাল্লাযীনা কাফারূঅর্থঃ হে ঈসা! আমি তোমাকে মৃত্যু দিব (অর্থাৎ বিরুদ্ধবাদীরা তোমাকে বধ করতে পারবে না) আমার দিকে উদ্ধরণ করব এবং কাফেরদিগের (অপবাদ) হতে তোমাকে পবিত্র করব (আলে ইমরান, রুকু ৬) এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ঈসা (আঃ) এর স্বাভাবিক মৃত্যুর পর আল্লাহ্ নিজের দিকে তাকে রাফাবা উদ্ধরণ করবেন এবং কাফেরদিগের মিথ্যা ইলজাম থেকে রক্ষা করবেনকিছুক্ষণ পূর্বে আমরা সুরা নেসায় পাঠ করে এসেছি যে, ইহুদীদের মিথ্যা দাবী খন্ডন করে আল্লাহ্ বলেছেন যে, ঈসা (আঃ)-এর রাফাহয়ে গিয়েছে অতএব এর দ্বারা প্রমাণ হল যে, আল্লাহ্‌র ওয়াদানুযায়ী প্রথম ঈসা (আঃ)-এর ওফাত বা মৃত্যু হয়েছে, অতঃপর আল্লাহ্‌র দিকে রাফাবা উদ্ধরণ হয়েছে এবং এতে কাফেরদিগের মিথ্যা ইলজাম থেকে তাঁকে পবিত্র করা হয়েছেঅনেকে বরেন মুতাওওয়াফফিকা অর্থ মৃত্যু নয়কিন্তু তা ঠিক নয় পবিত্র কোরআনের সর্বত্র তাওওয়াফফীমৃত্যু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেযেমন, ‘ওয়াল্লাযিনা ইউতাওওয়াফফাওনা মিনকুমঅর্থঃ আর তোমাদের মধ্যে যারা মরে যায় (বাকারা রুকু, ৩১) ওয়া তাওওয়াফফানা মায়াল আবরার, অর্থঃ আর আমাদিগকে সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গে মৃত্যু দাও (আলে ইমরান, রুকু ২০)হাত্তা ইযা জায়া আহাদাকুমুল মাওতু তাওয়াফফাতহুঅর্থঃ আল্লাহর প্রেরিত ফেরিশতা মৃত্যু ঘটায় (আনআম, রুকু ৮) রাব্বানা আফরিদ আলায়না সাবরাওঁ ওয়া তাওওয়াফফানা মুসলিমীনঅর্থঃ হে আমাদের প্রভু! আমাদিগকে ধৈর্য দান কর এবং মুসলমান অবস্থায় আমাদিগকে মৃত্যু দান কর তফসীর বয়জবী, আবু সউদ, কবীর, ইবনে জরীর, কাতাদা ইবনে কসীর, ফারা, রুহুল বয়ান প্রভৃতিতেও মুতাওওয়াফফিকাঅর্থ মৃত্যু করা হয়েছে আরবী ভাষায় বিখ্যাত অভিধান তাজুল উরুস, লেসানুল আরব ও কামুসেও এর অর্থ মৃত্যু লিখা রয়েছে সহী বোখারী কিতাবুত তফসীরে বর্ণিত হয়েছে যে, কালা ইবনে আব্বাসিন মুত্তাওওয়াফফিকা মুমিতুকা অর্থঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, মুতাওওয়াফফিকা অর্থ মৃত্যু আমরা জানাযার দোয়ায় বলে থাকি, ‘ওমান তাওওয়াফফায়তাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আলাল ঈমানেঅর্থাৎঃ হে আল্লাহ্! যদি আমাদেরকে মৃত্যু দাও তা হলে ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু দিওআহ্‌মদীয়া জামাতের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ (আঃ) চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন যে, যদি রাত্রি এবং নিদ্রার সম্পর্ক বিদ্যমান না থাকে আর আল্লাহ্ কর্তা হন তা হলে তাওওয়াফফীঅর্থ মৃত্যু ব্যতিরেকে যদি অন্য কিছু হয় বলে কেউ আরবী সাহিত্য থেকে প্রমাণ করতে পারেন তা হলে তিনি সেই ব্যক্তিকে এক সহস্র টাকা পুরস্কার দিবেন (ইযালায়ে আওহামঃ ৩৭৫ পৃঃ) কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম হন নিআমরা হঠকারীদেরকে পুনরায় আহবান জানাচ্ছি যে, যদি তারা পারেন তাহলে প্রমাণ পেশ করে আমাদের নিকট থেকে ঐ টাকা নিয়ে যেতে পারেনওমা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূলুন কাদ খালাত মিন কাবলিহির রুসুলু আফা ইম্মাতা আওকুতিলান কালাবতুম আলা আকাবিকুম(আলে ইমরান, রুকূঃ ১৫) অর্থঃ মোহাম্মদ রসূল ব্যতিরেকে অন্য কিছু নহে, আর পূর্বের সকল রসূল মরে গিয়েছে, অতএব, যদি সে মরে যায় অথবা কতল হয় তা হলে কি তোমরা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে? এখানে খালাতশব্দ ব্যবহৃত হওয়ায় ঠিক নয়, কেননা, আয়াতে গত হওয়ার দুটি পথ বর্ণনা করা হয়েছে যথা, মৃত্যু এবং কতল, অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীগণ এই দুই ভাবেই গত হয়েছেন, অতএব নবী মোহাম্মদ (সাঃ)ও যদি এইরূপে গত হয়ে যান তাহলে কি মুসলমানগণ মুরতাদ হয়ে যাবে? এই বলে আল্লাহ্ প্রাথমিক মুসলমানদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন

আরবী ভাষার সর্ব বৃহৎ অভিধান তাজুল উরুসে আছে, ‘খালা ফলানুনবললে এর অর্থ হয়, অমুক ব্যক্তি মরে দিয়েছেসহী বোখারী দ্বিতীয় খন্ডে আছে, আঁ হযরতের যখন মৃত্যু হল তখন হযরত ওমর (রাঃ) বলতে লাগলেন, ‘যে ব্যক্তি বলবে রসূলের ওফাত হয়েছে, আমি তার শিরচ্ছেদ করবএর পর হযরত আবূ বকর (রাঃ) এসে আঁ হযরতের মুখের চাদর উন্মোচন করে দেখলেন এবং বাইরে এসে সকলকে সম্বোধন করে উপরে বর্ণিত আয়াত পাঠ করলেনঅর্থাৎ এই আয়াত পাঠ করে তিনি সকলকে জানিয়ে দিলেন যে, পূর্ববর্তী সকল নবীর ন্যায় হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)ও মৃত্যু প্রাপ্ত হয়ে গত হয়ে গিয়েছেনএর পর বললেন, ‘ইয়্যা আইয়্যুহাননাসু মান কানা মিনকুম ইয়াবুদু মুহাম্মাদান ফাকাদমাতা ওমান কানা ইয়্যাবূদুল্লা ফা ইন্নাল্লাহা হাইয়্যুন লা ইয়ামূতুঅর্থাৎঃ হে লোক সকল! যারা মোহাম্মদের উপাসনা করতে তারা জেনে রাখ যে, তিনি মরে গেছেন আর যারা আল্লাহর উপসনা কর তারা জানবে তিনি চিরঞ্জীব,তিনি মরবেন নাতখন ঈসা (আঃ) জীবিত আছেন বলে কেউই প্রতিবাদ করলেন নাঅতএব, এই আয়াতে খালামৃত্যু অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছেঈসা (আঃ)-এর পূর্ববর্তী নবীদের সম্বন্ধেও এইরূপ খালাশব্দ প্রয়োগ করা হয়েছেযথাঃ মাল মাসীহুবনু মারয়ামা ইল্লা রাসূলুন কাদ খালাত মিন কাবলিহির রসূলঅর্থঃ মসীহ ইবনে মরিয়ম একজন রসূল ব্যতীত অন্য কিছু নহে, তার পূর্ববর্তী সকল রসূলই গত হয়ে গিয়েছে(মায়েদা, রুকূঃ ১০) এখানে ঈসা (আঃ)-এর পূর্ববর্তী নবীগণ যেভাবে গত হয়ে গিয়েছেন ঠিক সেই ভাবে আঁ-হযরত (সাঃ)-এর পূর্বের নবীগণও গত হয়ে গিয়েছেনঅতএব ঈসা (আঃ)-এর জীবিত থাকার আর কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না

উপরে উল্লিখিত সুরা মায়েদার আয়াতে আরও বলা হয়েছে,‘ওয়া উম্মুহু সিদ্দিকাতুন কানা ইয়াকুলানিত্‌ তায়ামাঅর্থঃ (ঈসার) মাতা এক সাধ্বী রমণী ছিল, তারা উভয়েই (ঈসা ও মরিয়ম) খাদ্য খেত (মায়েদা, রুকূঃ ১০)এখানে বলা হয়েছে যে, ঈসা ও তার মা খাদ্য খেতেন অর্থাৎ এখন আর খান নাঅথচ আল্লাহ্ বলেন,‘ওমা জায়ালনাহুম জাসাদল লাইলা কুলুনাত্‌ তায়ামা ওমা কানু খালীদিনঅর্থঃ: আল্লাহ্ তার রসুল দিগকে এমন দেহ দেন নাই যে,তাঁরা না খেয়ে বাঁচতে পারে; আর না তার অস্বাভাবিক দীর্ঘ আয়ুর অধিকারী ছিল (আম্বিয়া রুকূঃ ১) এই আয়াতে ঈসা (আঃ)-এর না খেয়ে দুই হাজার বৎসর জীবিত থাকা মিথ্যা বিশ্বাশকে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছেসুরা আম্বিয়ার তৃতীয় রুকুতে আছে,‘ওমা জায়ালনা লিবাশিম মিন কাবলিকাল খলদা আফা ইম্মিত্তা ফা হুমুল খালেদুনঅর্থঃ: আর (হে মোহাম্মদ!) তোমার পুর্বে কোন মানুষকেই আমি অস্বাভাবিক দীর্ঘায়ু দান করিনিঅথচ তুমি মরে যাবে আর অন্যরা জিবিত থাকবে? এর দ্বারাও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুই প্রমান হয়কিন্তু আশ্চর্য ! এর পরেও আমাদের গয়ের আহ্‌মদী ভাইয়েরা হযরত মোহাম্মদ (সা:) কে মৃত এবং ঈসা (আঃ) কে জীবিত মনে করে থাকেনঈসা (আঃ) নিজের সম্বন্ধে বলেন,‘ওয়া আওসাইনী বিস সালাতি ওয়ায্‌ যাকাতি মা দুমতু হাইয়া’(মরিয়ম, রুকূঃ ২) অর্থঃ আল্লাহ্ আমাকে হুকুম করেছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামায পড়তে ও যাকাত দিতে দিনরাত যারা যাকাতের টাকার অন্বেষণে ঘুরে ফিরছে তারাও বলতে পারবেনা যে, ঈসা (আঃ) এখন যাকাত দিয়ে থাকেনঅতএব এর দ্বারাও প্রমান হয় যে ঈসা (আঃ) এখন আর জীবিত নেইকেননা, জীবিত থাকলেই নামায পড়া ও যাকাত দেয়া তাঁর উপর ফরজ বাধ্যতামূলক হবেসুরা নহলের দ্বিতীয় রুকুতে আছে, ‘ওয়াল্লাযিনা ইয়াদউনা মিনদুনিল্লাহি লা ইয়খলুকুনা শাইয়াওঁ ওয়াহুম ইউখলাকুন আমওয়াতুন গায়রু আহ্‌ইয়াইনঅর্থঃ তারা যাদেরকে খোদার পরিবর্তে আহবান করে থাকে তারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনা বরং তারাও সৃষ্টএরা জীবিত নয় মৃত খ্রীষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে উপাস্যরুপে মান্য করে থাকেকিন্তু আল্লাহ্, বলেছেন যে এই সকল ঝুটা এবং কল্পিত উপাস্যগুলি জীবিত নয় বরং মৃতএই আয়াত দ্বারাও খ্রীষ্টানদের মাবুদ (ঈশ্বরপুত্র) ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু প্রমাণ হয়সুরা মায়েদার শেষ রুকুতে বর্নিত হয়েছে যে, খ্রীষ্টানদের বর্তমান বিশ্বাস সম্বদ্ধে আল্লাহ্‌তাআলা ঈসা (আঃ)-কে জিজ্ঞেস করবেন যে, এইরূপ বিশ্বাস তিনি লোকদিগকে শিক্ষা দিয়েছেন কিনাতখন ঈসা(আঃ) বলবেন সুবহানাকা মাইয়া কুনুলি আন আকুলা মা লাইসালি বি হাক্কিন ইনকুন্তু কুলতুহু ফাসাদ আলিমতাহু তালামু মা ফি নাফসিকা ইন্নাকা আনাতা আল্লামুল গুয়োবমা কুলতু লাহুম ইল্লা মা আমার তানি বিহি আনি বুদুল্লাহা রাব্বি ওয়া রাব্বাকুম ওয়া কুনতু আলাইহিম শাহিদাম মা দুমতু ফিহিম ফালাম্মা তাওয়াফফায়তানী কুনতা আনতার রকিবা আলাহিম ওয়া আন্তা আলাকুল্লে শাইইন শাহীদঅর্থঃ পবিত্রময়! আমি কি করে তা বলবো যা বলার কোন হক আমার নেই আর যোদি বলেই থাকি তা হলে তুমিই জ্ঞাত আছ, তুমি জান আমার অন্তরে যা আছে কিন্তু আমি জানি না তোমার অন্তরের কথা, কেননা তুমিই একমাত্র অদৃশ্য সম্বদ্ধে জ্ঞাত আমি তা ই বলেছিলাম যা তুমি আমাকে বলতে আদেশ করেছিলে বলেছিলাম,উপাসনা কর আল্লাহর যিনি আমার এবং তোমাদের প্রভু, এবং এই বিষয়ে আমি সক্ষি ছিলাম,যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, অতঃপর যখন তুমি আমাকে মৃত্যু দিলে তখন তুমিই পর্যবেক্ষক,আর তুমিইতো সর্ববিষয়ে সম্যক সাক্ষিএই আয়াত পাঠে জানা যায় যে, ঈসা (আঃ) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন খ্রীষ্টানগন সৎপথে ছিল কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তারা ঈসা (আঃ)-উপাস্য রূপে গ্রহন করেছেঈসা (আঃ)-কে জীবিত রাখার জন্য এখনও যারা শেষ চেষ্টা করছেন, তারা হয়ত বলবেন যে,এই কথোপকথন কেয়ামতের সময় হবে, এজন্য এর দ্বারা ঈসা (আঃ) এখন মৃত তা প্রমাণ হয়না কেননা কেয়ামতের পুর্বে তিনি আকাশ থেকে অবতরনকরবার পর মৃত্যুবরণ করবেনঅতএব, এখানে যখন আমাকে মৃত্যু দিলে দ্বারা অবতরণের পরবর্তীকালের মৃত্যুকে বুঝাচ্ছেএর উত্তর জেনে রাখা দরকার যে, খ্রীষ্টানগণ বহু পুর্বেই প্রকৃত শিক্ষা হতে দুরে সরে গিয়েছে, যদি সত্য সত্যই ঈসা (আঃ) আকাশ হতে অবতরন করে পুনরায় মর্ত্যে আগমন করেন তা হলে তিনি দেখতে পাবেন যে, খ্রীষ্টানগণ তাঁর অনুপস্থিতিতে ভ্রান্ত হয়েগিয়েছে এবং তাঁকে খোদার আসনে বসিয়ে পুজো করছেঅতএব, তিনি কিয়ামতের সময়ে বলতে পারবেন না যে খ্রীষ্টানগণ তাঁর মৃত্যুর পর সত্য ধর্ম হতে দুরে সরে গিয়েছেবরং তখন তাঁকে ফালাম্মা তাওয়াফফায়তানীস্থলে ফালাম্মা রাফাতানী ইলাস সামায়ী হাইয়া বলতে হবেঅর্থাৎ তাঁর জীবিত অবস্থায় আকাশে চলে যাওয়ার পর খ্রীষ্টানগন পথহারা হয়েছে বলতে হবেবোখারী শরীফের তৃতীয় খন্ডের কিতাবুত্‌ তফসীরে আছে ,রসুল করীম (সাঃ) কেয়ামতের দিনে তাঁর একদল সাহবীকে দোযখের দিকে নিয়ে যেতে দেখবেনতখন তিনি এরা আমার সাহাবীবলে আহবান করবেন, তখন তাঁকে বলা হবে যে, এরা আপনার মৃত্যুর পরে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলআঁ-হযরত (সাঃ) বলেন, ‘তখন আমি সেই উত্তরই দিব ,যে উত্তর ঈসা (আঃ) দিয়েছিলেনঅর্থাৎ কুনতু আলায়হিম শাহিদাম মা দুমতু ফিহীম ফালাম্মা তাওয়াফফায়েতানী কুনতা আনতার রকিবা আলায়হিম ইত্যদি এই হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, রসুল করীম (সাঃ)-এর ওফাতের পর যেমন তাঁর কতিপয় সাহাবী মরতাদ হয়ে গিয়েছিল, তদ্রুপ ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরও তাঁর উম্মত সত্য ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছেখাতামান্নাবীঈন হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর এই ব্যাখ্যার পর ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু সম্মদ্ধে কোন প্রকৃত মুসলমানের আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না

হাদীসে ওফাতে ঈসা(আঃ)

আল্লাহ্‌ বলেন, ফাবি আইয়ে হাদিসীন বাদাল্লাহি ওয়া আয়াতিহী ইউমিনুন (জাসিয়া রুকু, ১) অর্থাৎঃ আল্লাহ্ এবং তাঁর আয়াতের বিরূদ্ধে আর কোন হাদীস গ্রহনীয় হবে ? অতএব উপরে আমর কুরআন শরীফ থেকে যে সব প্রমাণ পেশ করে এসেছি এর পর আর কোন হাদীসের উল্ল্যেখ না করলেও চলে,তবুও পাঠকের অবগতির জন্য কয়েকটি হাদীস নিম্নে উদ্ধৃতি করলামইতিপুর্বে আলোচনায় আমরা সহী হাদীস গ্রন্থ বোখারী থেকে তিনটি হাদীস পেস করে এসেছি

একটি হাদীসে দেখেছি যে, আঁহযরত (সাঃ) নিজের মৃত্যু সম্বন্ধে তাওওয়াফাফীশব্দ ব্যাবহার করেছেন, তাছাড়া ঐ হাদীসে তাওওয়াফ্‌ফীশব্দযুক্ত কোরআনের আয়াত পেশ করে তিনি ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর প্রমাণ করে দিয়েছেনঅন্যত্র রসুল করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘লাও কানা মুসা ওয়া ঈসা হাইয়াইনী লামা ওয়া সিয়া হুমা ইল্লাত তিবায়ী(ইবনে কছির, জিলদ-২ পৃঃ২৪৬) অর্থঃ যদি মুসা ও ঈসা জীবিত থাকতেন তা হলে আমার অনুসরন ব্যাতিরেকে তাদের কোন গতি ছিল নাদেখুন, কেমন স্পষ্টভাবে এই হদীসে হযরত মুসা ও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর কথা বর্নিত হয়েছেঅন্য একস্থানে নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘আন্না ঈসাইবনা মরিয়ামা আশা ইশরিনা ওয়া মিয়াতা সানাতিন(তিবরানী, কনযুল, ওম্মাল জিলদ, ৬ ও মুয়াহিবুদ দুনয়া, ১ম খন্ড, ৪২ পৃঃ) অর্থঃ ঈসা (আঃ) একশত বিশ বছর জীবিত ছিলেনএই হাদীস নবী করীম (সাঃ) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন সহী হাদীসে আছে মিরাজে নবী করীম (সাঃ) ঈসা (আঃ) কে মৃত নবীদের মধ্যে দেখেছিলেন

বুযুর্গানে দীনের অভিমত

নবী করীম (সাঃ)-এর সাহাবাগণ ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন আঁ-হযরত (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর খলীফা আউয়াল হযরত আবূ বকর (রাঃ) যে ভাষণ দিয়ে ছিলেন তাতে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীর ওফাত হয়েছে বলে উল্ল্যেখ করেছেনআর উপস্থিত সকল সাহাবী প্রতিবাদ না করে এর সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন ঈসা (আঃ) একশত বিশ বৎসর জীবিত ছিলেন বলে হযরত ফাতেমা (রাঃ) বর্ণিত যে হাদীস ইতিপূর্বে উল্ল্যেখ করা হয়েছে তাতে বুঝা গেল যে, নবী করীম (সাঃ)-এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুতে বিশ্বাসী ছিলেনহযরত ইমাম হাসান (রাঃ) বলেন, ২৭শা রমযানের রাত্রে হযরত ঈসা (আঃ)-এরও মৃত্যু হয়েছিল (তাবাকাত ইবনে সাদ, জিলদ ৩)এই সব বর্ণনা থেকে প্রমাণ হয় যে, রসূল করীম (সাঃ)-এর পরিবারের সকলই হযরত ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুতে বিশ্বাস করতেনবোখারীতে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু প্রমাণকারী হাদীসগুলি ইমাম বোখারী (রাঃ) নিজ সহীতে লিপিবদ্ধ করায় প্রমাণ হল যে, তিনিও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুতে বিশ্বাসী ছিলেনইমাম মালেক (রঃ) ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুতে বিশ্বাস করতেন (মজমাউল বেহার, জিলদ, , পৃঃ ২৮৬)ইমাম হাজম (রঃ) ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন (আলমুহল্লা, জিলদ, , পৃঃ ২৩) মুতাজিলা ফিরকার বিশ্বাস হযরত ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে, (মজমাউল বয়ান, জিলদ ১)দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা কাসেম নানুতবী সাহেব বলেন, “হযরত আদম থেকে আরম্ভ করে যত নবী হয়েছেন সকলেই মৃত্যুবরণ করেছেন(লতায়েফ কাসেমীয়া, মুজতবায়ী প্রেস, দিল্লী, ২২ পৃঃ)

বর্তমান যুগের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত

মিশরের প্রাক্তন মুফতী আল্লামা রশিদ রেযা বলেছেন, ‘হযরত ঈসা (আঃ)-এর হিন্দুস্থানে হিজরত পূর্বক তথায় মৃত্যু হওয়া বিচার, বুদ্ধি ও ইতিহাসের বিরোধী নয় (রেসালা আলমিনার, জিলদ-৬, পৃঃ ৯০০, ৯০০১) কবি ইকবাল বলেন, ‘আহ্‌মদীদের বিশ্বাস যে, ঈসা (আঃ) একজন মরণশীল মানুষের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তাঁর দ্বিতীয় আগমনের অর্থ আত্মিকভাবে তাঁর মসীল আসবেন, কতকটা যুক্তিসঙ্গত (আজাদ, উর্দূ, ৬ই এপ্রিল, ১৯৫১ ইংরেজী) আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর, আল্লামা শেখ মাহমুদ সালতুত মরহুম লিখেছেন, ‘কুরআন করীম এবং সহী হাদীস হতে আমরা এমন কোন প্রমাণ পাই না যার উপর ঈসা (আঃ) এর সশরীরে আকাশে উত্তোলিত হয়ে এখন পর্যন্ত জীবিত থাকা এবং শেষ যুগে পৃথিবীতে পুনরাগমন কাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে থাকা সম্বন্ধে বিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করা যেতে পারে’ (আল ফতোয়া, মিশর সংস্করণ, ৫৮ পৃষ্ঠা; মুজাল্লাতুল আজহার, ফেব্রুয়ারী ১৯৬২ ঈসাব্দ)মৌলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ সাহেব তাঁর তফসীরে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন, (সূরা আল ইমরানের তফসীর দ্রষ্টব্য) জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদী বলেন, ‘ঈসার (আঃ) জীবিত থাকা এবং সশরীরে আকাশে উত্তোলিত হওয়া নিশ্চিতভাবে প্রতিপন্ন নহে এবং কোরআনের বিভিন্ন আয়াত হতে এ বিষয়ে প্রতীতি জন্মে না(বক্তৃতা, ২৮শে মার্চ ১৯৫১ ঈসাব্দ)তিনি ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুও স্বীকার করেছেন (তাফহিমুল কুরআন, ২য় খন্ড)

এছাড়াও খাজা হাসান নিযামী (আখবার মুনাদী, দিল্লী, ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬, পৃঃ ১৬), মুফতী আবদুহু, আল্লামা নিয়াজ ফতেপুরী এবং আবুল কালাম আযাদও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বীকার করেছেনজাহানে নওইসলামী আন্দোলন সংখ্যা, ১৯৬৯, ২৫ পৃঃ ও ৩৩ পৃষ্ঠায় ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু স্বীকার করেবাংলা দৈনিক আযাদের ৩রা মে তারিখের সংখ্যায় মৌলানা মোন্তাসির আহমদ রহমানী, ৬ই মে তারিখে এবং মৌলানা ওলিউর রহমান মুহাদ্দিস ১০ই মে সংখ্যায় ও আফতাব আহমদ রহমানী এম, এ (আরবী), গোল্ড মেডেলিস্টও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু স্বীকার করেছেন (মোহাম্মদীঃ কার্ত্তিক, ১৩৭০ বাংলা হইতে উদ্ধৃত)রাবেতা আলমে ইসলামী, মক্কা থেকে একখানা ইংরেজী তফসীর প্রকাশ করেছেনএতেও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু স্বীকার করা হয়েছে (১৭৭-৮০)নবী শ্রেষ্ঠ- ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ১৩৫ পৃঃ, বিজ্ঞানে মুসলমানের দান, ১ম খঃ ১৫ পৃঃ ও দৈনিক ইনকিলাব ৪ চৈত্র, ১৩৯৩ তেও ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যু স্বীকার করা হয়েছে

ঈসা (আঃ)-এর জীবিত থাকার বিশ্বাস মুসলমানদের মধ্যে কোথা হতে আসল?

মথি, মার্ক, লুক এবং যোহন লিখিত সুমাচার ব্যতীত খ্রীস্টানদিগের আরও অনেকগুলি সুসমাচার ছিলসেগুলি জাল এবং কাল্পনিক বলে পরবর্তীকালে খ্রীস্ট সমাজ কর্তৃক পরিত্যাক্ত হয়এই সব সুসমাচারের মধ্যে বার্ণাবার সুসমাচার(Gospel according to Barnaba) একটিএতে লিখিত আছে, ভুলক্রমে ইস্করিয়োতীয় যিহুদাকেই ক্রশে বধ করা হয়েছিলযিহুদা যখন সৈন্য সামন্ত নিয়ে যীশুখ্রীস্টকে ধৃত করবার নিমিত্ত উপস্থিত হয়েছিল তখন বিপদ দেখে ঈশ্বর গাব্রিয়েল ও অন্যান্য স্বর্গদূতকে যীশুকে জগৎ থেকে তুলে নেবার আদেশ দিয়েছিলেনতিনি (যীশু) গৃহের মধ্যে ছিলেন, দুতগণ তাঁকে জানালা দিয়ে বের করেছিলেন এবং তৃতীয় স্বর্গে দুতগণের মধ্যে স্থাপন করলেন, যেন তিনি অনন্তকাল পর্যন্ত ঈশ্বরের স্তবগান করেন যখন শিষ্যগণ গৃহমধ্যে নিদ্রিত ছিলেন তখন যিহুদা সবিক্রমে তথায় প্রবেশ করল এবং সেই মুহূর্তে আশ্চর্য ঈশ্বর আশ্চর্য কার্য করলেন - যিহুদাকে আকৃতি ও কথাবার্তায় সম্পূর্ণ যীশুর মত পরিবর্তিত করলেন এবং আমরা (শিষ্যগণ) তাকে যীশু বলেই গ্রহণ করলামযিহুদা আমাদিগকে জাগ্রত করে প্রভুকে খুঁজতে লাগল, এতে আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমরা (শিষ্যগণ বললাম, ‘প্রভু আপনিই তো আমাদের প্রভু, আপনি কি আমাদেরকে ভুলে গিয়েছেন’? সেও ঈষৎ হেসে উত্তর করল, ‘তোমরা কি এমন বোকা যে, আমাকে ঈস্করিয়োতীয় যিহুদা বলে চিনতে পারছ না?’ এই কথার পরেই সৈন্যগণ গৃহে প্রবেশ করে তাকে গ্রেফতার করল, কারণ সর্বতোভাবে তার চেহারা যীশুর চেহারার মত হয়েছিলযিহুদা যখন বাধা দান করল তখন সৈন্যদল অধৈর্য হয়ে তাকে লাথি, চড় ও বিদ্রুপ করে যিরুযালেমে নিয়ে গেলকালক্রমে এই ভ্রান্ত বিশ্বাসই মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ লাভ করেঈসা (আঃ) এর পরিবর্তে কাকে শূলে দেয়া হয়েছিল সে সম্বন্ধেও বিভিন্ন মুফাসসিরের মধ্যে মতভেদ আছেকেউ বলেন, ঐ ব্যক্তির নাম টিটেনাস ছিল, কেউ বলেন, ফলতিয়ানাস, কেহ বলেন, ইহুদীরাজ সুয়ুগ, আবার কেউ কেউ বলেন তার নাম স্বর্গীয়ান ছিল, একদল বলেছেন, ইস্করিয়োতীয় যিহুদা, অন্যদল বলেন, কুরীনীয় শিমোন

ঈসা (আঃ) এর আকাশে যাওয়া এবং এখনও জীবিত থাকার বিশ্বাস খ্রীস্টানদের দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ লাভ করেছে (দেখুন, ফৎহুল বয়ানঃ ৩য় খন্ড, ৪৯ পৃঃ)

একটা কাল্পনিক বিশ্বাস

অনেকে বলেন ঈসা (আঃ) নাকি রসূল করীমে (সাঃ) এর উম্মত হওয়ার জন্য আকাঙ্খা করেছিলেন তাই আল্লাহ্ পাক তাঁকে জীবিত অবস্থা সশরীরে চতুর্থ আকাশে হাজার হাজার বৎসর যাবৎ রেখে দিয়েছেন যাতে শেষ যুগে আখেরী নবীর উম্মত করে দুনিয়ায় পাঠাতে পারেনএই বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুলকুরআন হাদীসে এর কোন সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায় নাবরং রসূল করীম (সাঃ) এর মিরাজ দ্বারা এই বিশ্বাস ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় কেননা, রসূল করীম (সাঃ) মিরাজে ঈসা (আঃ)-কে মৃতদের মধ্যে দ্বিতীয় আকাশে দেখেছিলেন তাছাড়া হযরত আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস দ্বারাও এই বিশ্বাস বাতিল হয়ে যায়হাদীসটি এই, বর্ণিত আছে যে, ‘একদা আল্লাহ্ তাআলা মূসা (আঃ)-কে বললেন যে, তুমি বনী ইস্রাঈলকে বলে দাও, যে ব্যক্তি আহমদ (সাঃ)-কে অস্বীকার করে আমার নিকট হাজির হবে সে যেই হোউক না কেন আমি তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবমূসা (আঃ) বললেন, এই আহমদ কে? ইরশাদ হল, হে মূসা! কসম আমার সম্মান ও প্রতাপের, আমি এমন কোন কিছু সৃষ্টি করিনি যা তার চেয়ে আমার কাছে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন, আমি তার নাম আমার নামের সঙ্গে আকাশ পৃথিবী, চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টির বিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে আরশে লিখে রেখেছিলামআমার ইজ্জত ও প্রতাপের শপথ, জান্নাত আমার সমস্ত সৃষ্টির জন্য হারাম যতক্ষণ না মোহাম্মদ এবং তার উম্মত তাতে প্রবেশ করে, (এর পর উম্মতে মোহাম্মদীয়ার ফযিলত বর্ণনা করলেন) অতপর মূসা (আঃ) আরজ করলেন, হে প্রভু! আমাকে এই উম্মতের নবী করে দিন এরশাদ হল, এই উম্মতের নবী ঐ উম্মত হতেই হবেমূসা (আঃ) আরজ করলেন, তাহলে আমাকে ঐ উম্মতে মোহাম্মদীয়ার মধ্যেই দাখিল করে দিন ইরশাদ হল, তুমি প্রথমে হয়ে গিয়েছ কিন্তু ওরা পরবর্তী কালে হবেমৌলানা আশরাফ আলী থানবীও তাঁর নসরুত্তিব’, নামক পুস্তকের ১৯৩ পৃষ্ঠায় (দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত) এই হাদীসটি উল্ল্যেখ করেছেনএই হাদীস দ্বারা দেখা যায় যে, মহানবী (সাঃ)-এর উম্মত হওয়ার জন্য মূসা (আঃ)-এর প্রার্থনা আল্লাহ্ তাআলা এই বলে নামঞ্জুর করলেন যে, ‘তুমি প্রথমে হয়ে গিয়েছ কিন্তু ওরা পরবর্তী কালে হবেঅতএব ঈসা (আঃ) পূর্বের হয়ে পরে কি করে উম্মতে মোহাম্মদীয়অতে আবির্ভুত হবেন? এটা কি আল্লাহর এই স্পষ্ট ফরমানের বিরুদ্ধে যায় না? তাছাড়া উপরে বর্ণিত হাদীস দ্বারা এও প্রমাণ হল যে, এই উম্মতের নবী এই উম্মত (অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদীয়া) হতেই হবেউম্মতি নবী সম্বন্ধে যথাস্থানে আলোচনা করা হবেঅতএব প্রতিশ্রুত মসীহ যে এই উম্মত হতেই হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেইরসূল করীম (সাঃ) বলেছেন, “আলা আন্নাহু খালিফাতি ফি উম্মতি আলা আন্নাহু লাইসা বাইনি ওয়া বাইনাহু নাবীউন(তিবরানী) অর্থাৎঃ তিনি (প্রতিশ্রুত মসীহ্‌) আমার উম্মত হতে আমার খলীফা হবেন এবং তাঁর ও আমার মধ্যখানে কোন নবী নেই

প্রাপ্ত সূত্রঃ ওফাতে ঈসা ও মসীলে ঈসা - আলহাজ্জ আহমদ তৌফিক চৌধুরী

No comments:

Post a Comment

ওয়ানপ্লাসের নতুন অক্সিজেন ওএস ১৫ আসছে AI নিয়ে

  অ্যান্ড্রয়েড ১৫  এর ওপর ভিত্তি করে আসছে  ওয়ানপ্লাসের  অক্সিজেন    ওএস  ১৫। অক্টোবরের ২৪ তারিখ বাংলাদেশ সময় রাত ৯:৩০ এ আনুষ্ঠানিকভাবে অপ...