Tuesday, September 13, 2011

টাকায় কেনা যায় ঢাবি বুয়েটের সার্টিফিকেট!(সত্যিই উচ্চ শিক্ষার হার বাড়ছে)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র, নম্বরপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ সবই পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর নীলক্ষেতে। একাডেমিক কোন যোগ্যতা না থাকলেও টাকার বিনিময়ে এখান থেকে জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করছেন শত শত মানুষ। জাল সার্টিফিকেট সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য শুধু নীলক্ষেতেই সীমাবদ্ধ নেই, এখন সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের চেয়ে রাতে বেশি চলছে এ অবৈধ কর্মকান্ড। বিভিন্ন কৌশল আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসাধু চক্র গভীর রাতে এ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অনৈতিক কর্মকান্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

ইত্তেফাককে বলেন, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন প্রতারণা মেনে নেয়া যায় না। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে তদন্ত করে বিষয়টি বের করা হবে। তিনি অবিলম্বে নীলক্ষেতে এ কর্মকান্ড বন্ধের জন্য সকলের সহযোগিতা চান।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী চক্র নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট, গাউসুল আজম মার্কেটে অবৈধভাবে জাল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র তৈরির কাজ করে আসছে। তবে এই অবৈধ কর্মকান্ডের বিষয়টি প্রশাসনসহ অনেকেই জানলেও চক্রটি থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের হুবহু সার্টিফিকেট তৈরি করে ওই চক্রটি, দেখে কোনভাবে বোঝা যাবে না এটা নকল সার্টিফিকেট। এসব অবৈধ কর্মকান্ড দিনের চেয়ে রাতেই বেশি করা হয়। দিনে নেয়া হয় কাজের অর্ডার। আর রাত ৮টায় মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর অবৈধ বিদ্যুত্ সংযোগ নিয়ে চলে এ রমরমা ব্যবসা। ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা সার্টিফিকেটে নাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বসিয়ে দেয়া হয়। দেখতে হুবহু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের মতোই। তফাত্ শুধু একটাই ওই সার্টিফিকেটটির বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, হল অফিস ও প্রশাসনিক ভবনে রেকর্ড নেই। জালিয়াতির তালিকায় আরো রয়েছে পুলিশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, আদালতের পরোয়ানা, জামিননামা, ইউপি চেয়ারম্যানের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট, বিভিন্ন খেলা ও ইভেন্টের টিকিট, ব্যাংকের চেক, এটিএম বুথের কার্ডও।

সম্প্রতি র্যাব নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটের শামীম কম্পিউটার্স নামের একটি দোকানে অভিযান চালিয়ে সেখানে থাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সনদপত্র, নম্বরপত্র, মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, বিভিন্ন ধরনের সিল, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ও প্রিন্টার জব্দ করে। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় রিয়াদ ও মুরাদ নামের দুই কর্মচারীকে।

কারা এই জাল সার্টিফিকেটের ক্রেতা

ঢাকার তিতুমীর সরকারি কলেজে ইংরেজিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ডেনমার্কে পাড়ি জমান (ছদ্মনাম) ফাহমিদুল ইসলাম। সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তিনি। কিন্তু কাজের পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অনার্স ও মাস্টার্সের সার্টিফিকেট ও নম্বরপত্র। অতঃপর এক বন্ধুর পরামর্শে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময় সংগ্রহ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার সার্টিফিকেট ও নম্বরপত্র। অনুরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র (ছদ্মনাম) ফুয়াদ হাসানের অনার্স পরীক্ষা শেষ হলেও এখনো ফল প্রকাশ হয়নি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বিজ্ঞাপন দিলেও কোনোটাতেই আবেদন করতে পারছিলেন না। অতঃপর এক বন্ধুর পরামর্শে অনার্স পরীক্ষার একটি সার্টিফিকেটের মডেল নিয়ে হাজির হন নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে। ওয়াসার পানির পাম্পের পাশের একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে ৩ হাজার টাকার বিনিময় বানিয়ে নেন অনার্সের সার্টিফিকেট। দোকানের মালিক জানান, বিভিন্ন সার্টিফিকেটের মডেল পেলে সে অনুযায়ী সার্টিফিকেট বানিয়ে দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে খরচটা অনেক কম। আর মডেল না আনলে খরচ একটু বেশি। তিনি বলেন, আমার কাছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটের মডেল আছে। যে কোন ধরনের সার্টিফিকেট তার দোকানে বানানো সম্ভব বলে দাবি করেন তিনি।

সক্রিয় সিন্ডিকেট

ঢাকার নীলক্ষেতের প্রায় সব কম্পিউটার কম্পোজের ছোট ছোট দোকানে তৈরি করা হচ্ছে জাল সার্টিফিকেট ও সনদ। এছাড়াও ফার্মগেইট, যাত্রাবাড়ি, মতিঝিল, চকবাজার এলাকায়ও এসব কাজ হচ্ছে। তবে এসব কাজ করা হচ্ছে অত্যন্ত গোপনে। নীলক্ষেত এলাকার দোকানীরা মিলে গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট। প্রথমদিকে দোকানের সামনে চলমান মানুষের গতিবিধি লক্ষ্য করেই প্রস্তাব দেন দোকানীরা। গতকাল দুপুরে প্রথমে বেশ কয়েকটি দোকানে গিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ও নাগরিক সনদপত্র তৈরির বিষয়ে আলাপ করা হয়। প্রায় সব দোকানই যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দিতে রাজি হয়। কারো কারো কাছে গিয়ে কথা বললে তারা প্রথমে বিষয়টি এড়িয়ে যায়, তবে এক পর্যায়ে রাজিও হয়। কথা হয় ‘ই’ আদ্যাক্ষরের একটি ফটোস্ট্যাটের কর্মচারী সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সার্টিফিকেটের কথা বললে ৮ হাজার টাকা দাবি করে সে। অর্ডার নিয়ে পরের দিন তা দেয়া হবে বলে জানানো হয়। তবে সে বলেছে, এসব বিষয়ে দোকানের মালিক কিছু জানে না। একইভাবে ‘জে’ আদ্যাক্ষরের একটি দোকানের কর্মচারী জাল সার্টিফিকেট বানানোর সত্যতা স্বীকার করেন।

এছাড়াও ‘না’, ‘রু’, ‘সো’, ‘এ’ আদ্যাক্ষরের দোকানগুলোও জাল সার্টিফিকেট বানানোর প্রস্তাব দিলে রাজি হয়ে যায়। তবে জাল সার্টিফিকেট তৈরির জন্য দর কষাকষি করা হয় দোকানের বাইরে। বিশেষ করে ওয়াসার পানির পাম্পের সামনে। বাকুশাহ মার্কেটেই নয়, জাল সার্টিফিকেট ও নম্বরপত্র গাউসুল আজম সুপার মার্কেটেও তৈরি করা হয়। এই মার্কেটের দোকানীরা জানান, কম্পিউটার কম্পোজ করে আয় কম। তাই জাল কাগজপত্র তৈরি করা হয়। এতে আয়ও অনেক বেশি। ৫ মিনিটেই ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এমনকি মেডিক্যাল সার্টিফিকেটও তারা তৈরি করে থাকেন। তারা আরো জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, বিভিন্ন মেডিক্যাল, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, সনদপত্র, নাগরিক সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক সার্টিফিকেট, ব্যাংক চেক বই সবই তারা করতে পারেন।

যেভাবে তৈরি করা হয় সার্টিফিকেট

জাল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের আইডি কার্ড তৈরিতে কম্পিউটার দোকানগুলো বিশেষ কিছু পন্থা অবলম্বন করে। বিশেষ করে ফটোশপের মাধ্যমে কম্পিউটার অপারেটররা দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো করে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের কম্পিউটারে বেশকিছু সার্টিফিকেট ও কার্ডের মডেল রয়েছে। গ্রাহকের চাহিদামতো তারা এসব মডেল দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করেন। তাদের রয়েছে স্ক্যানার মেশিন, যা দিয়ে তারা প্রথমে একটি মূল সার্টিফিকেট স্ক্যান করেন। এরপর এ মডেলের ওপর নাম, রোলসহ সব তথ্য পরিবর্তন করে তৈরি করেন আসল সার্টিফিকেটের আদলে একটি জাল সার্টিফিকেট। পরবর্তী সময়ে এটি সার্টিফিকেটে ব্যবহূত কাগজের মতো এক ধরনের কাগজে প্রেসে নিয়ে ছাপানো হয়। তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ছাপাখানার যোগাযোগ রয়েছে। সেখানেই তারা এগুলো ছাপিয়ে থাকেন।

তত্পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জাল সার্টিফিকেটধারীদের সনাক্ত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ তত্পর। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজনের সার্টিফিকেট জাল হিসিবে সনাক্ত করে তা বাতিল করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান ইত্তেফাককে বলেন,নীলক্ষেতে জাল সার্টিফিকেট তৈরির বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি। বেশ কয়েকবার অভিযানও চালানো হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে তত্পর থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

ক্ষুব্ধ বুয়েট কর্তৃপক্ষ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, কোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়েও কয়েকটি সার্টিফিকেট জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। নীলক্ষেতে সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়টি আমরা নজরে রাখছি। ইতিমধ্যে পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

পুলিশের বক্তব্য

নিউমার্কেট থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান ইত্তেফাককে জানান, এখন আর নীলক্ষেতে এ ধরনের কাজ হয় না। এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত তারা নিজস্ব কম্পিউটার, ল্যাপটপে করে থাকে। নীলক্ষেত এলাকায় সার্টিফিকেট জালকারীদের ধরতে প্রতিমাসে অভিযান পরিচালনা করছি। এছাড়াও র্যাব-ডিবি তাদের সনাক্ত করতে কাজ করছে বলে তিনি জানান।


লিঙ্কঃএইখানে ক্লিক করেন

No comments:

Post a Comment

ওয়ানপ্লাসের নতুন অক্সিজেন ওএস ১৫ আসছে AI নিয়ে

  অ্যান্ড্রয়েড ১৫  এর ওপর ভিত্তি করে আসছে  ওয়ানপ্লাসের  অক্সিজেন    ওএস  ১৫। অক্টোবরের ২৪ তারিখ বাংলাদেশ সময় রাত ৯:৩০ এ আনুষ্ঠানিকভাবে অপ...