ঈশ্বর কণা
মহাবিশ্ব সৃষ্টি নিয়ে যখনই কোন আলোচনা হয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে উঠে আসে। আর তা হল... মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছনে সত্যিই কি সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের হাত রয়েছে?
এই প্রশ্নে আস্তিক এবং নাস্তিকদের মাঝে যুক্তি তর্কের শেষ নেই।
আসুন দেখি মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা কি বলেনঃ
একটি বিন্দু থেকে সব কিছুর সৃষ্টি।
ধারনা করা হয় তখন মহাবিশ্বের আয়তন ছিল একটি পরমাণুর থেকেও ছোট এবং তাপমাত্রা ছিল কয়েক বিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেই ছোট বিন্দুটি হঠাৎ হারিয়ে ফেলে তার মহাকর্ষন শক্তি এবং প্রসারিত হতে থাকে অসীম গতিতে চারদিকে।
এই প্রসারণকে বলা হয় "নিনাদ তত্ত্ব" বা "বিগ বেং"।
বর্তমানে জানা তথ্যের উপর ভিত্তি করে মহাবিশ্বের বয়স দাঁড়ায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর এবং আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস ১৮৫ বিলিয়ন আলোক বর্ষ।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে সব কিছুই শক্তিরূপে বিরাজ করতো। প্রচণ্ড নিনাদের ফলে আদিতে সৃষ্টি হয় মোট ১২টি কণা।
এই কণাগুলো বস্তুর আদিরূপ হলেও এদের স্থায়ীত্ব নেই। অন্য কণাগুলোকে সৃষ্টি করেই এরা আবার অস্তিত্বহীন হয়ে যায়।
ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীরা ১১টি আদি কণা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ১২ নম্বর কণাটি এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যৌক্তিক বিশ্বাসের মধ্যেই থেকে গিয়েছিল।
পদার্থবিজ্ঞানের মতবাদ অনুযায়ী মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং গঠন রহস্য সমাধানের মূল চাবিকাঠিই হচ্ছে এই ১২ নম্বর কণাটি। কয়েক দশক ধরে এই ১২ নম্বর কণাটির অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
এই কণাটির অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন আইনস্টাইনের সহকর্মী ভারতীয় বাংগালী বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কণাটির বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হিগস। তাই এই কণার নাম দেওয়া হয় হিগস-বোসন।
এতদিন কল্পিত কিন্তু মহাজগতের সৃষ্টি রহস্যের ব্যাখ্যার জন্য অপরিহার্য এই কণাটি মানুষের অজানাই রয়ে গিয়েছিল।
সুইজারল্যান্ডের ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সার্ন) গবেষকেরা গত ৪ জুলাই এই হিগস-বোসন কণার অনুরূপ একটি কণা আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত এই নতুন কণাটির বৈশিষ্ট্যাবলীর সাথে হিগস-বোসন কণার নাকি ৯৯.৯৯৯ ভাগ মিল রয়েছে।
প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে সুইজারল্যান্ড ফ্রান্স সীমান্তের কাছে ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি কৃত্রিম ভূগর্ভস্থ পরীক্ষাগারে একটি মিনি সাইজের কৃত্রিম বিগ বেং ঘটানো হয়।
এই কৃত্রিম বিগ বেং ঘটানোর মধ্যেই বিজ্ঞানীরা তাদের প্রত্যাশিত দ্বাদশ কণাটি খুঁজে পান।
মহাবিশ্বে প্রতিটি বস্তুর ভর সৃষ্টির প্রাথমিক ভিত্তি হচ্ছে একটি অদৃশ্য কণা। বস্তুর ভরের মধ্যে ভিন্নতার কারণও এই অদৃশ্য কণাটিই।
পদার্থবিদ্যার যে তত্ত্বটির সাহায্যে কোনো বস্তুর ভরের ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় তাকে ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ বলে। এই স্ট্যান্ডার্ড মডেলটির অস্তিত্বশীল হতে হলে প্রয়োজন পড়ে হিগস-বোসন কণার।
হিগস-বোসন কণাটিকে “গড পার্টিকেল” যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “ঈশ্বর কণা” নামেও ডাকা হয়। যদিও এই ধরণের নামকরণের সাথে ধর্মের কোন যোগাযোগ নেই।
শোনা যায়, ১৯৯৩ সালে লেডারম্যান হিগস-বোসন কণার বিষয়ে লেখা তাঁর বইটির নাম দিতে গিয়ে একসময় খানিক উষ্মাভরেই বলে ফেলেছিলেন, গড ড্যাম পার্টিকেল! আর , ঝানু প্রকাশক তা মুহূর্তেই লুফে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাজার কাটতির জন্য নাম টা একটু ছেঁটে ‘গড পার্টিকেল’ রাখার জন্য প্রকাশক প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন লেডারম্যানের কাছে। এরপরই বইটির নাম রাখা হয়েছিলো “দ্য গড পার্টিকেল” বা “ঈশ্বর কণা”।
এই কণার অস্তিত্ব বিগ বেং তত্ত্বের প্রায় পূর্ণতা দিয়েছে বলে দাবী করা হচ্ছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির অনেক অজানা রহস্য উদঘাটনে এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে অনেকে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ছবি: CERN, via Associated Press
No comments:
Post a Comment